১৩ নভেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ২:৩৫

সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

বিএনপির নেতৃত্বাধীন তেইশ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য তাদের অনুরোধ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা স্থগিত রাখতে রাজি হয়নি। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১২ নবেম্বর পুন:তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৯ নবেম্বরের পরিবর্তে ২৮ নবেম্বর করা হয়েছে, ৩০ ডিসেম্বর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সিইসি গতকাল সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পুন:তফসিল ঘোষণা করেছেন। সিইসি তার ভাষণে বলেছেন যে, নির্বাচন প্রার্থীরা ইচ্ছা করলে অনলাইনে নমিনেশন পেপার জমা দিতে পারবেন। তিনি আরো বলেছেন যে, এই প্রথমবারের ন্যায় নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে এবং তা শহর এলাকাতে সীমাবদ্ধ থাকবে। ইভিএম ব্যবহারে কারিগরি সহায়তা করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হবে বলে তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন।

সিডিউল ঘোষণা এবং রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটাবে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আবার অনেকে অবাধ নিরপেক্ষ এবং সকল দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান বিদ্যমান অবস্থায় অসম্ভব বলে মনে করেন। তাদের ধারণা, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধীদলগুলোর সকল দাবি-দাওয়া সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যান, সকলের জন্য নির্বাচনী ময়দান সমান মসৃণ রাখতে তাদের আপত্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের দলীয় লেজুড়পনা, নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনাকে ভ-ুল করে দিবে এতে সরকারের এজেন্ডাই বাস্তবায়িত হবে, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হবে না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জন্য এটি একটি অশনি সংকেত। বলাবাহুল্য আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমল থেকে বিএনপি ভাঙার যে অনুশীলন চলে আসছিল ২০০৮ সালের আঁতাতের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে এই দদলটির নেতৃত্বে গঠিত সরকারও সেই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই এগিয়ে চলেছে। ষড়যন্ত্রের মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার জেল, তার শাস্তি মওকুফের আপিলে শাস্তির মেয়াদ দ্বিগুণ বৃদ্ধি, নির্মমভাবে তার ছেলে ও বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে নির্যাতন ও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে বাধ্য করা ও পরবর্তীকালে তার সংশ্লিষ্টতাহীন দুর্নীতির মামলায় তাকে শাস্তি প্রদান ও দেশে ফেরার পথ রুদ্ধ করা প্রভৃতি একই সূত্রে গাঁথা বলে তারা মনে করেন। বিএনপি ভাঙার লক্ষ্য এখনো তারা অর্জন করতে পারেনি। তবে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে যথাক্রমে জেলখানা ও প্রবাসে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা সফল হচ্ছেন বলে মনে হয়। জিয়া পরিবারকে উৎখাতের তাদের লক্ষ্য দুর্ভেদ্য হয়নি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা এত বড় একটি রাজনৈতিক দল কিভাবে এই পরাজয় মেনে নেয় তা দেখার বিষয়।

উল্লেখ্য যে, গত ১০ বছরে এদেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। যে সরকার পরিচালনার জন্য তারা কর দিয়েছে, খাজনা দিয়েছে, সে সরকার গঠনের জন্য তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যর্থতা অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার আদায়ের জন্য বিরোধী দলগুলোর প্রতি তাকিয়ে ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের ২০ দলীয় (বর্তমানে ২৩ দলীয়) জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ বিরোধী দল ও জোটসমূহের ৭টি দাবির কোনো দাবিই সরকার মানলেন না। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের সংলাপ ব্যর্থ হলো। তিনি সবাইকে পত্র পাঠ বিদায় করে দিলেন। বললেন যে, সংবিধান পরিপন্থী কোনো দাবিই তিনি মানতে পারবেন না। বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়, কেননা এটা কোর্টের ব্যাপার, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার সম্ভব নয় কেননা সংবিধানে তা নেই, পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দেয়া সম্ভব নয়, কারণ সংসদ রেখেই সংবিধান নির্বাচন দিতে বলেছে।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা যাবে না, কেননা সময় নেই। রাজবন্দীদের মুক্তিও দেয়া যাবে না। কারণ তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তা আদালতের এখতিয়ার। গায়েবি অভিযোগে প্রতিদিন শত শত বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া অব্যাহত রয়েছে। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনী কারচুপির হাতিয়ার ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানিয়েছিলেন, কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন যে, শহর এলাকায় তা ব্যবহার করা হবে। এতে করে মনে হচ্ছে যে, সরকারি দলের ইচ্ছা ও অভিলাসের প্রতিফলনই আসন্ন নির্বাচনে হতে যাচ্ছে। তাদের ইচ্ছা হচ্ছে, পুনরায় ৫ জানুয়ারির ন্যায় একটি প্রহসনের নির্বাচন করে তৃতীয়বারের ন্যায় ক্ষমতা দখল করে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসা।

যেহেতু পুন:তফসিলে মনোনয়নপত্র গ্রহণ, বাছাই, প্রত্যাহার ও ভোটগ্রহণের তরিখ পেছানো হয়েছে, এতে প্রস্তুতির জন্য দলগুলো হয়তো আরো কিছু সময় পাবে। কিন্তু তাতে সামগ্রিক অবস্থার কী পরিবর্তন হবে? নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি কি পূরণ হবে? বেগম জিয়াসহ সকল রাজবন্দী কি মুক্তি পাবে? বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের ওপর গায়েবি মামলা, হামলা গ্রেফতার কি বন্ধ হবে? পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী জাতিসংঘসহ কিছু কিছু বিদেশী রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অতীতেও তারা আগ্রহ দেখিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি কোন লাভ হবে?
নির্বাচনের সব কিছুই এখন সরকারি কব্জায়। সরকার ও সরকারি দল এখন এক হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের নেতাকর্মী-প্রার্থীরা সরকারি সুবিধা ভোগ করে সকল নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে সিডিউল ঘোষণার তিনমাস আগে থেকে দেশব্যাপী দলীয় প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের পোস্টার ও রং বেরং এর ফেস্টুনে সারাদেশ ছেয়ে গেছে। বড় বড় মিটিং ও মহাসমাবেশ হচ্ছে। হাজার হাজার ও শত শত বাস-ট্রাকে করে লোক আনা হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের সভা সমিতিতে যাতে লোক আসতে না পারে, সেজন্য গাড়ি ঘোড়া বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। নগরীর হোটেলগুলোতে পুলিশী নজরদারি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এটা কোনো রাজনীতি? এই রাজনীতি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুকূল নয়। নির্বাচনের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকা অপরিহার্য্য। এই তালিকাটি সর্বশেষ দলীয় লোকদের দিয়ে হাল নাগাদ করানো হয়েছে। ফলে এতে ছাত্রলীগ যুবলীগের অনেক নাবালক ছেলে মেয়ে যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তেমনি অনেক বৈধ ভোটারও বাদ পড়েছে। ওপার বাংলার লোকদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন পরিচালনা করবেন কারা? সাধারণত: জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরাই প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার হয়ে থাকেন। পুলিশ ও আনসার বাহিনী পাহারায় থাকেন। গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের দলীয় বাহিনী ছাড়া উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহে কেউ চাকরি পাননি। এই অবস্থায় দলীয় কর্মচারীদের স্থলে নিরপেক্ষ কর্মচারীদের হাতে নির্বাচনী দায়িত্ব না দিলে কারচুপি হবার সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশ এখন খুনী, সন্ত্রাসী ও দাগী আসামীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টালে খুন, গুম, ছিনতাই রাহাজানি, নারী নির্যাতন প্রভৃতির খবর দেখে শিউরে উঠতে হয়। প্রকাশ্যে গুলী করে, কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে। ঘরে ঢুকে গুলী করে হত্যা করা হচ্ছে। পেশাদার অপরাধী খুন ডাকাতির দায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামীরা জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। সরকার তাদের মাফ করে দিচ্ছে। তারা জনপদে ফিরে এসে নতুন উদ্যমে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কিছুই করছে না। তারা ব্যস্ত বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। বিরোধী দলগুলো তাদের ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও চালাতে পারছেন না। সেখানে পুলিশ হানা দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে নাশকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনার মামলা দিচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনে অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পেশাদার অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দেশকে নরকে পরিণত করছে।

পুলিশ পেশাদারিত্ব হারাচ্ছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং মিথ্যাচারের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে ঘৃণাও বিদ্বেষের সৃষ্টি হচ্ছে। একটা সংগঠিত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জন্য এটা শুভ হতে পারে না। বাংলাদেশে এখন এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যা দলীয়করণ করা হয়নি। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র আওয়ামী লীগের দলীয় আনুগত্যের লোকেরা প্রচ- প্রতাপে ক্ষমতাসীন। প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের লোকদের কথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উঠ-বস করে। প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করছেন এবং এই প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীও তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই অবস্থার অতি রাজনৈতিক একটি প্রশাসন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় প্রবল শক্তিধর, কলহ প্রিয়, আক্রমণ প্রবণ প্রতিহিংসা পরায়ণ ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট একজন ব্যক্তির অধীনে এবং এমপিদের স্ব-স্ব পদে রেখে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদিচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভবপর নয়। এজন্য আন্দোলন ও ঝাঁকুনী দরকার। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে যদি তারা প্রবল একটা ঝাঁকুনি দিতে পারেন তবেই স্বৈরতন্ত্র পরাজিত হবে এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।

http://www.dailysangram.com/post/353178