১১ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ২:০১

তফসিলের পরের দিন বিরোধী ৩০০ নেতাকর্মী গ্রেফতার; বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ; হচ্ছে নতুন মামলাও

এক দিকে উৎসবের আমেজ অন্য দিকে গ্রেফতার আতঙ্ক

তফসিল ঘোষণার পর একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। গতকাল শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো মনোনয়নের জন্য দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছে দলটির সম্ভব্য প্রার্থীরা। ধানমন্ডি কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে রঙবেরঙের ব্যানার, ফেস্টন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল করছেন প্রার্থীর সমর্থকেরা। অন্য দিকে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা। তফসিল ঘোষণার পরের দিন শুক্রবার বিরোধী দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দায়ের হচ্ছে নতুন নতুন মামলাও। নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা তার ভাষণে বলেছেন, নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য অভিন্ন আচরণ ও সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা হবে। দেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার অনুকূল আবহ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধান দুই জোটের মধ্যে একটি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। অন্যটি মামলা এবং গ্রেফতার এড়াতে ঘরছাড়া হয়ে আছে। এ অবস্থায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তাদের তৈরি করতে হবে। বিগত ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন যেন না হয়, সে ব্যাপারে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, তাড়াহুড়া করে তফসিল ঘোষণার কারণ বোধগম্য নয়। তবে এটা বুঝতে পারি যে, তফসিলটা নভেম্বরের শেষে ঘোষণা করতে পারত ইসি। যথেষ্ট সময় ছিল, এত তাড়াহুড়ার কোনো দরকার ছিল না। নভেম্বরের শেষের দিকে তফসিল করলে ২০ জানুয়ারির দিকে নির্বাচন হতো। তাহলে আরো কিছু সময় পাওয়া যেত। সরকারের সাথে বিরোধী দলের সংলাপ হলে হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়ে আসত। এটাই আমরা আশা করে আসছিলাম; কিন্তু সেটা হলো না। বিরোধীদলীয় জোট নির্বাচনে অংশ না নিলে একতরফাভাবেই নির্বাচন হবে বলে মনে করেন তিনি।

সংস্থাটির প্রধান সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, এর আগে সিটি নির্বাচনে দেখা গেছে, কমিশন নির্দেশনা দিচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো মানছে না। খুলনা সিটি নির্বাচনের তদন্ত হলো, কেউ কেউ দায়ী হলেন, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিল না কমিশন। জাতীয় নির্বাচনেও মনে হয় না কমিশন কোনো উদ্যোগী ভূমিকা নেবে।

দিলীপ কুমার সরকার বলেন, সরকারবিরোধীরা সব দিক থেকে কোণঠাসা অবস্থায় আছে। এ ক্ষেত্রে তাদের পথ দুইটা, হয় নির্বাচন, নয় আন্দোলন। নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা যদি মনে করে, তাদের দাবি মানছে না, এর আগে সিটি নির্বাচনগুলোতেও ব্যাপক গ্রেফতার-হয়রানি, কর্মীরা মাঠে ভালোভাবে নামতেই পারেনি, সে দিক থেকে তারা মনে করতে পারে, নির্বাচনে যাবে না। অন্য দিকে নির্বাচনে না গেলে নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি, তা ছাড়া দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা উদগ্রীব হয়ে আছে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে কি না। এই বিষয়গুলো কাজ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে স্থানীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। গত ৩০ জানুয়ারি সিলেটের জনসভার মধ্য দিয়ে তিনি শুরু করেন অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল এবং ২২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর জনসভায় নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন। ৩ মার্চ খুলনায় এবং ৭ মার্চ রাজধানীতে জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব জনসভায়ও প্রধানমন্ত্রী নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেছেন।

অন্য দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাজিমউদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। তফসিলের পরের দিনও তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দায়ের করা হয়েছে মামলাও।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গতকাল শনিবার টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও কালিহাতী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শুকুর মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত দুই দিনে ঝিনাইদহে ৩৮৫ জন, বগুড়ার শেরপুরে অর্ধশতাধিক, কুমিল্লায় ৬৩ জন, বরগুনার আমতলী, বামনা, পাথরঘাটা থেকে ১১ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাজধানীর নিউ মার্কেট থানার কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সরদারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে সাতজন, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি গ্রেফতার হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদল নেতা সাইদুল ইসলাম লাকীসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এ ছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় এক সপ্তাহে দেড় শতাধিক ও ফুলপুরে ৪৯ বিএনপির নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল ধামরাইয়ে পাঁচ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তিনটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ধামরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তমিজ উদ্দিন, ঢাকা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন ফেরদৌস মুরাদসহ ৯১ জনের নাম উল্লেখসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। আর মিথ্যা মামলায় পুলিশ ধামরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গতকাল পর্যন্ত বিএনপির ১২ নেতাকর্মীকে আটক করেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/363756