৭ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:১৩

শিল্পখাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

ঋণ ফেরত দিতে চায় না বড় উদ্যোক্তারা

শিল্পখাতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এ খাতের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই বড় উদ্যোক্তাদের। কিন্তু ঋণ পরিশোধে তাদের অনীহা থাকায় সামগ্রিকভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বেশির ভাগ বড় শিল্প উদ্যোক্তা ঋণ নবায়ন করতে চাচ্ছেন ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই। এতে ব্যাংকগুলো পড়েছে মহাবিপাকে। এক দিকে উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ না করলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে বর্ধিত হারে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা থেকে। ফলে ব্যবসাবাণিজ্য মন্দার কারণে ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। অপর দিকে ব্যাংকে আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় নতুন কোনো বিনিয়োগ দিতে পারছেন না। আমানত প্রবাহ কমে যাওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বাড়তি প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।

গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে কথাগুলো বলছিলেন দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি। তার কথার সত্যতা মেলে শিল্পঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের খাতভিত্তিক খেলাপি ঋণের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শিল্প ঋণে খেলাপির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৩৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ২৩ হাজার কোটি টাকাই বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের। আর ছোট, মাঝিারি ও বড় শিল্প মিলে আলোচ্য সময়ে ঋণ রয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করাটা ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেকৃত কারণে না কোনো যৌক্তিক কারণ আছেÑ এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল একজন শিল্প উদ্যোক্তাকে। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু বড় উদ্যোক্তা আছেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করাটা যাদের জন্য রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে না পারছে ব্যাংক, না পারছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে গোটা আর্থিক খাতই কিছু বড় গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তবে বেশির ভাগ ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী ইচ্ছেকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না এটা একেবারেই ঠিক না। প্রকৃত বিষয় হলো, ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আর এর অন্যতম কারণ হলো, ব্যবসায়ীরা দেশে-বিদেশে ব্যবসায় তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছেন। যেভাবে প্রতিযোগিতা বাড়ছে ওইভাবে ব্যবসায়ীরা এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সক্ষমতা অর্জন করতে পারছেন না। এর অন্যতম কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে যে পরিমাণ সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ এখনও ডাবল ডিজিটে অর্থাৎ ১২ শতাংশ বা এর ওপরে রয়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে তারা ঋণের সুদহার কমিয়েছে। কিন্তু কমানো হয়েছে স্বল্প মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে। তাও আবার ৯ শতাংশ হারে। দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের সুদহার এখনও ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এর বাইরে নানা সার্ভিস চার্জ তো রয়েছেই। অপর দিকে ডলারের বিপরীতে টাকা যেটুকু অবমূল্যায়িত হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে প্রতিযোগী দেশগুলোর নিজস্ব মুদ্রার সাথে। সব মিলে ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমে গেছে। আর এর প্রভাব পড়ছে শিল্পখাতের খেলাপি ঋণের ওপর।

তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তারা নানা অজুহাতে ঋণ পরিশোধ করছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে অনেক উদ্যোক্তা নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নবায়ন করছেন। কিন্তু ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে আবার কেউ কেউ ঋণখেলাপি ঠেকাতে উচ্চ আদালতে রিট করছেন। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। অপর দিকে বড় কিছু উদ্যোক্তা নামে-বেনামে ঋণ নিচ্ছেন। প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলাও যাচ্ছে না। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন দিতে পারছে না। নানাভাবে তাদের ঋণ নিয়মতি দেখানো হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। তবে তাদের অনেকেই প্রকৃত খেলাপি ঋণ আড়াল করে মুনাফা দেখানোর চেষ্টা করছে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/362845