৪ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ২:৩৬

বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বৈধভাবে কর্মরত আছেন ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশী। তারা ৩৩ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ১৬ ক্যাটাগরিতে কাজ করছেন। বিশ্বের ৪৪টি দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন এসব নাগরিক। এই বিদেশী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতের আর সবচেয়ে কম উজবেকিস্তানের। ভারতের ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন এবং উজবেকিস্তানের ১৬৫ জন নাগরিক এদেশে কর্মরত আছেন। এসব বিদেশী কর্মীর বেশিরভাগই ঢাকায় বসবাস করেন। এর বাইরে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও তাদের উপস্থিতি দেখা যায়।

বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের প্রকৃত সংখ্যা কত সে বিষয়ে সরকারের কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিও ব্যুরোর মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর কোনটির কাছেই বিদেশীদের সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য নেই। এক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্যটির তথ্যেও মিল নেই। তবে বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে কর্মরত আছেন প্রায় ১০ লাখ বিদেশী।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈধভাবে বসবাস করছেন ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯ জন বিদেশী নাগরিক। বিদেশীরা কর্মরত আছেন এমন এক হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক কোম্পানিকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। ধারণা করা হচ্ছে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আরও কয়েক হাজার হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশে বিদেশীদের সংখ্যা দুই লাখ। এরা বিদায়ী ২০১৫ সালে দেশ থেকে নিয়ে গেছে ৫০ লাখ ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে দু’টি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। এই পরিমাণ অর্থ আমাদের রেমিট্যান্স আয়ের এক-তৃতীয়াংশের সমান। কিন্তু সিপিডির দেয়া তথ্য মতে, শুধু ভারতের পাঁচ লাখ নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে রয়েছেন। এরা ভারতে নিয়ে গেছে ৩৭৮ কোটি ডলার। টাকার হিসাবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। এসব অবৈধ বিদেশী রাজস্ব ফাঁকিও দিচ্ছে। বর্তমান রাজস্ব আইনানুসারে বিদেশীদের অর্জিত আয়ের ৩০ শতাংশ কর দেয়ার নিয়ম রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান ওয়ার্কপারমিট ছাড়া বিদেশীদের নিয়োগ দিলে এই কোম্পানির প্রদেয় আয়করের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বা কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এ বিধান কার্যকর হচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এরপর অবৈধভাবে লাখ লাখ বিদেশী এখানে কাজ করায় দেশের নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশীদের অনেকে মাদক চোরাচালান, জাল মুদ্রা ব্যবসা, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, মানবপাচার ও হুন্ডির সঙ্গে জড়িত রয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিদেশীদের অনেকে বাংলাদেশী জাল পাসপোর্ট ও জাল ন্যাশনাল আইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যবহার করছে। অনেকে আবার ভোটার তালিকাতেও নাম তুলেছেন।

গবেষকরা বলছেন, বিদেশীরা কেন, কী কাজে বাংলাদেশে এসেছেন, কতদিন থাকবেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠাগুলোর তথ্য সমন্বয় জরুরি। এনবিআর’র কাছে বিদেশী উদ্যোক্তা নিয়ে তথ্য থাকলেও বিদেশী কর্মীদের বিষয়ে কোনও তথ্য নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশীরা ইমিগ্রেশন দিয়ে যখন প্রবেশ করছে তখনই কে কোন ব্যপারে এসেছেন তা নির্ধারণ হওয়া জরুরি। মোট সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ না। তবে কতজন কোন কাজে এসেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মাথা ব্যথা তাদের নিয়ে যারা বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। ছাত্র, উদ্যোক্তা, চিকিৎসা বা পর্যটনের জন্য যারা আসছেন তাদের ব্যাপারে কিছু বলার নেই। কারণ, তাদের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে।

গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে এমনিতেই বেকারের সংখ্যা অনেক। এ অবস্থায় বিদেশীরা এসে কেন কাজ করছে সেটা চিন্তার ব্যপার। বিদেশী যারা বেতনভুক্ত কর্মী এবং যাদের বিকল্প বাংলাদেশে আছে তাদের নিয়েই মুলত চিন্তা।
তিনি বলেন, গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে দেখা যায়, এইচআর (হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট) এর একটা বড় অংশ বিদেশী। অথচ বাংলাদেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো যা পড়ায় তার শতকরা ৯০ ভাগই ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-বিবিএ আর মাস্টার্স অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এমবিএ। টেক্সটাইল, ডাইংসহ যেগুলো আমাদের উৎপাদনের প্রধান খাত সেসব জায়গায় প্রচুর বিদেশী কাজ করছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতেও প্রচুর বিদেশী কাজ করছে। আমাদের স্থানীয় চাকরির বাজারকে আশংকায় ফেলে বিদেশীরা কোথায় কাজ করে, কেন করে, কতজন করে তার উপর গবেষণা জরুরি।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিও ব্যুরো-এই তিন সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশী কর্মীদের কাজ করার অনুমতি দেয়। পোশাক, বস্ত্র, চামড়াসহ বেসরকারি শিল্প খাতের জন্য বিডা, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য বেপজা এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় বিদেশীদের কাজ করার অনুমতি দেয় এনজিও ব্যুরো। তথ্য বলছে, ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছে প্রায় ১৭ হাজার বিদেশী কর্মী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর’র তথ্য অনুযায়ী, ১৫ হাজার বিদেশী নাগরিকের তথ্য থাকলেও আয়কর দেন এমন বিদেশীর সংখ্যা ১৪ হাজার।

সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যে অমিল
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তুরস্ক, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান, ইউক্রেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৪৪টি দেশের নাগরিক বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। এই সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন। সংখ্যার দিক থেকে ভারতের নাগরিকরাই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। দেশটির ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন কর্মী বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। এর পরেই চীনের স্থান। দেশটির ১৩ হাজার ২৬৮ জন নাগরিক বাংলাদেশে কর্মরত আছেন। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে জাপানের ৪ হাজার ৯৩ জন, দক্ষিণ কোরিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫ জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৮০ জন, শ্রীলংকার ৩ হাজার ৭৭ জন, থাইল্যান্ডের ২ হাজার ২৮৪ জন, যুক্তরাজ্যের ১ হাজার ৮০৪ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৪৪৮ জন, জার্মানির ১ হাজার ৪৪৭ জন, সিঙ্গাপুরের ১ হাজার ৩২০ জন, তুরস্কের ১ হাজার ১৩৪ জন বাংলাদেশে কর্মরত আছেন।

অন্যদিকে, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকের কথা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯ জন। তবে এদের মধ্যে কে কোথায় কিভাবে বসবাস করছেন, কর্মরত আছেন তার সব তথ্য এসবি’র কাছে নেই। এসবি’র এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অবস্থানরত অন্য একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে কর্মরত আছেন প্রায় ১০ লাখ বিদেশী। আর অবৈধ বিদেশী কর্মীদের বড় অংশই পর্যটক ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। নিবন্ধিত না হয়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তারা। অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়েও এসেছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে প্রবেশের পর ঠিকানা পরিবর্তন করায় পরে খোঁজ করে আর পাওয়া যায় না তাদের। যারা পর্যটক ভিসায় এসে কাজ করেন তাদের বড় অংশই তিন বা ছয় মাস পর নিজ দেশে ফিরে গিয়ে পুনরায় ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন। অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীদের বেশিরভাগই ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান ও মালদ্বীপের বাসিন্দা।

ভিসা আছে কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট নেই
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট-রামরু’র পরিচালক সি আর আবরার বলেন, বিদেশী কর্মীদের অনেকের হয়তো ভিসা আছে কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট নেই। কাজেই কাজ করার অনুমতি নাই তাদের এখানে। প্রথমত এটার একটা সংখ্যা নিরুপন করা জরুরি। কোন সেক্টরে কারা, কিভাবে কাজ করছেন তা জানা দরকার। বাংলাদেশের শ্রমিক যারা বিভিন্ন দেশে আছেন তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। আমাদের দেশে যদি ওই ধরনের শ্রমিক থেকে থাকেন তাহলে সেই তথ্যটা জানা কিন্তু রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।

শেষ হয়নি এনবিআর গঠিত টাস্কফোর্সের কাজ
বিদেশী নাগরিকদের নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করতে ২০১৬ সালে এনবিআর’র উদ্যোগে গঠিত হয়েছে টাস্কফোর্স। তবে টাস্কফোর্স কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি। বিডা, এসবি, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর-ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদফতর-এনএসআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেপজা, পাসপোর্ট অধিদফতর, এনজিও ব্যুরো ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিরাও এর সঙ্গে যুক্ত আছেন।

http://www.dailysangram.com/post/351966