৪ নভেম্বর ২০১৮, রবিবার, ২:৩৪

কর্মহীন জিডিপি অর্থনীতিতে বোঝা

বিগত কয়েক বছরে গড়ে ১০০ ডলারেরও বেশি বাড়ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গড় আয় বাড়লেও মোটা দাগে সুফল পাচ্ছে না দেশের ২০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যার ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। কিন্তু সরকার বলছে, সুষম উন্নয়নে কাজ করছে তারা। এতে বৈষম্য কমে আসবে। দেশে ধনীর সংখ্যা বাড়লেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। এতে বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে। কর্মহীন জিডিপি অর্থনীতিতে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, প্রতি বছরই কাগজ কলমে মাথাপিছু আয় এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ছে। বৈষম্য কিন্তু কোনভাবেই কমছে না। তাহলে এ জিডিপির ফল কারা ভোগ করছে। কার স্বার্থে এই জিডিপি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর সুফল কি তারা পাচ্ছে।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শিল্পের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কর্মসংস্থান না হওয়ার কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির। আর অর্থনীতিকে অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধি নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে। এটি অর্থনীতির অত্যন্ত খন্ডিত ও অসম্পূর্ণ চিত্র। সবচেয়ে দুস্থ মানুষটি অর্থনীতি থেকে কতটা পেল, সেটা বিবেচ্য হওয়া উচিত। তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলেছেন, জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বাড়লে কি লাভ হবে। কার লাভ হবে। আমি তো কোন লাভ দেখছি না। তাহলে এ নিয়ে এত বেশি কথা বলে কি লাভ।

জিডিপি বাড়লে তো দেশে সে হারে কর্মসংস্থানও বাড়বে। বৈষম্যও কমবে। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টোটা। দেশে কোন বিনিয়োগ হচ্ছে না। উল্টো বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্বের সংখ্যাও। আমরা যদি মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিজেদের নাম লিখাতে চাই তাহলে অবশ্যই এসব বৈষম্য কাটিয়ে উঠতে হবে। তা না হলে বৈষম্য আরও বাড়বে।

আব্দুল মোমেন দিনমজুরী পেশায় নিয়োজিত দুই দশক ধরে। গত এক বছরে তার মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫০ টাকা। অথচ খরচের খাতা দীর্ঘ হচ্ছে পাগলা ঘোড়ার গতিতে। এমন চিত্র দেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক কৃষকের।

পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ২০১২-১৩ অর্থবছরে মানুষের গড় আয় ছিল ১০৫৪ মার্কিন ডলার। আর সবশেষ অর্থবছরে যা দাঁড়িয়েছে ১৭৫১ মার্কিন ডলারে। এ হিসাবে প্রতি বছর মানুষের গড় আয় বাড়ছে ১০০ ডলারেরও বেশি। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশের মোট আয়ের ৩৮ ভাগই আছে দেশের শীর্ষ ধনীদের পকেটে।

পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখনও দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশ। যেখানে চরম দারিদ্র্যের হিসাব ১১ শতাংশের ঘরে। অর্থনীতিবিদরা তাই বলছেন, ধনীর আয় অনেকগুণ বাড়লেও সে অনুপাতে মোটাদাগে আয় বৃদ্ধির বাইরে রয়ে গেছে বড় সংখ্যার এই জনগোষ্ঠী। ফলে, মাথাপিছ আয় বাড়ার সুফল মিলছে না মোটাদাগে।

অর্থপ্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান জানালেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরিতে নজর রয়েছে সরকারের। আমরা সামাজিক নিরাপত্তার আওতা আরও বাড়িয়েছি। সব ধরনের ভাতা বাড়নো হয়েছে। এতে করে দারিদ্য্রতার সংখ্যা আরও কমে আসবে। বৈষম্যও আরও কমে আসবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

কর্মসংস্থান না হওয়ার উদাহরণ দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পোশাক খাতে এত উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। যারা কাজ করছেন, তারাই আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছেন।

বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা না হওয়ায় জিডিপির বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ব্যুহ ভেদ করতে পারছি না। জিডিপিতে যে বাড়তি বিনিয়োগ আসছে, তা রাষ্ট্রের বিনিয়োগ থেকে আসছে। ভোগের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত অংশটি আসছে, তা-ও রাষ্ট্রের ভোগ। ভোগ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে রাষ্ট্র দিয়েই অর্থনীতি ধাবিত হচ্ছে।

চার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, প্রথমত, অবৈধ উপায়ে অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্বাচন যত সামনে আসে, অর্থ পাচার তত বাড়ে। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার দেশগুলোতে বিনিয়োগই বেশি লাভজনক মনে করেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। তাই পুঁজি দুর্ভিক্ষের দেশ এখন পুঁজি রপ্তানির দেশে পরিণত হচ্ছে। তৃতীয়ত, অর্থনীতি ব্যয়বহুল ভোগকাঠামোর দিকে যাচ্ছে। এর উদাহরণ বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রিতে এশিয়ায় পঞ্চম বাংলাদেশ। চতুর্থত, গত কয়েক বছরে উদ্যোগী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে।

চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে জানিয়ে সিপিডি বলেছে, ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে সাময়িক হিসাব দেওয়া হয়েছে, তা প্রথম তিন-চার মাসের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। সাময়িক হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তথ্য নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া হাওর অঞ্চলে বিপর্যয়ের কারণে এ বছর বোরো ধান প্রায় ১৬ লাখ টন কম পাওয়া যাবে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ।

মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশ হওয়ার জন্য যে আকাক্সক্ষা, এর সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবাহের বিষয়টি মিলছে না বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

সিপিডি মনে করে, আগামী বাজেটে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইনে নতুন হার ১২ শতাংশে নামানো উচিত। নতুন ভ্যাট আইন উৎপাদক ও ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আয়করের নিম্নতম স্তরটি ১০ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ করার সুপারিশ করে সিপিডি।

সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছর শেষে মূল রাজস্ব আদায়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন গতানুগতিক। ২০১২ সালের পর থেকে বিদেশী সহায়তার ব্যবহার সর্বনিম্ন। সুশাসনের অভাবে বা জবাবদিহি কম থাকায় দেশজ উৎসের অর্থ সহজে ব্যবহার করা যায়। এ জন্য সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সিপিডি বলছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তিন মাস পর পর মূল্যস্ফীতির তথ্যপ্রকাশ করবে বিবিএস এটি খুবই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে অর্থনীতির সঠিক চিত্র যেমন আসে না, তেমনি নীতিনির্ধারণে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ জন্য স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করা যেতে পারে।

ইসলামী ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাতে পরিবর্তন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৃহত্তম ঋণ গ্রহণকারী যখন মালিক হয়ে যান, তখন তা চিন্তার বিষয়। ব্যাংকটির চলমান ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা থাকা দরকার, তা দেখছি না। এ ব্যাংকের পরিবর্তন মসৃণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা থাকা দরকার।
এব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, প্রবাসী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। এতে করে দেশে অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু তারা তেমন বিনিয়োগে সুযোগ পাচ্ছে না। তারা রাষ্ট্রের কোন সুযোগ সুবিধা পচ্ছে না। একইভাবে দেশের গামের্ন্টস শ্রমিকরা অল্প বেতনে কাজ করছে। তাদের ভাগ্য উন্নয়ন না হলেও রাষ্ট্রের উন্নতি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, দেশে অল্প কিছু মানুষ রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বাকিরা সবাই বঞ্চিত হচ্ছে। দুনিয়ার কোথায়ও নেই যেখানে সরকারি কর্মচারির বেতন-ভাতা শতভাগ বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা বেড়েছে শতভাগের চেয়ে বেশি। অথচ যারা দেশের জন্য কাজ করছে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নেই।

বিশ্ব ব্যাংকে বাংলাদেশ অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ধনীরা ধনী হচ্ছে আর গরীবরা গরীব হচ্ছে। এতে বৈষম্য বাড়ছেই। ধনীরা তাদের অর্থ বিনিয়োগ করছে না। এতে করে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এটি অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক সংবাদ দেয়।

http://www.dailysangram.com/post/351969