৩ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:১৭

সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করেছে সঞ্চয়পত্র

সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করছে সঞ্চয়পত্র। এতে ব্যয়ও বাড়ছে। সরকার কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্থাৎ বেশি সুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ায় দেশের আর্থিক খাত বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছে। এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার অন্যতম উদ্দেশ্য ‘ব্যয় ও ঝুঁকি কমানো’ নীতিরও ব্যত্যয় ঘটছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল তার অর্ধেকের বেশি ঋণ নিয়ে ফেলেছে তিন মাসেই। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট ২২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ বেশি। মোট বিক্রি হওয়া এই ২২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকার মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদে ৮ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৩ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। অথচ এবারের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এ হিসাবে মাত্র তিন মাসেই সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশি অর্থ ধার করে ফেলেছে সরকার।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে। রাজস্ব বাজেটের একটি বড় অংশ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ শোধে ব্যয় হচ্ছে। এর সিংহভাগই সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে চলে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা এবং ব্যাংক আমানতের সুদের হার কমায় সবাই এখন নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে। সে কারণেই প্রতি মাসেই বিক্রি বাড়ছে। বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা।
এদিকে ঋণের বোঝা কমাতে সরকার কয়েক দফা সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত কমায়নি। নির্বাচনের আগে কমানোর কোন সম্ভাবনা নেই। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি মহিলাদের পরিবার এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো উচিৎ। বাজেট ব্যবস্থাপনায় শৃংখলা রাখতেই এটা করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে বলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে মে মাসে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু বাজেট অধিবেশনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের দাবির পরিপেক্ষিতে শেষ পর্যযন্ত অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাননি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেও অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও একই কারণে কমানো হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করবে বলে ঘোষণা দিলেও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও ব্যাংকে টাকা রাখলে ৪/৫ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যায় না। সঞ্চয়পত্র কিনলে ১২ শতাংশের মতো পাওয়া যায়। তাহলে মানুষ কেনো ব্যাংকে টাকা রাখবে।

চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য ৫১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ সুদ শোধের জন্যই রাখা হয়েছে ৪৮ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশী ঋণেল সুদ পরিশোধের জন্য।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছরই বাজেটের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। যার মধ্যে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) মোট বিক্রি এবং নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি এবং ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটে ১৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও বছর শেষে বিক্রি হয় ৩৪ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে লক্ষ্য ছিল ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট আয় হয় ১১ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এর তিনগুণেরও বেশি ২৮ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বিক্রি করে সরকার।

ব্যাংকে আমানতের সুদহার কম থাকায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। বর্তমানে ব্যাংক আমানতে সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ। অন্যদিকে কমানোর পরও বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদহার ১১ থেকে ১২ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে কমিয়ে আনা হয় ২ শতাংশ। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বর্তমানে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ।
সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তায় সঞ্চয়পত্র প্রকল্প চালু হলেও এখন আর সাধারণ মানুষ কিনতে পারছে না। কাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র? তাঁদের বেশির ভাগ কি সাধারণ মানুষ? এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, না। সরকারি বড় পদের কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সঞ্চয়পত্র বেশি কিনছেন। করের টাকায় বিপুল অঙ্কের এই সুদের বরাদ্দও তাঁদের জন্যই। সমাজের কোনো কোনো শ্রেণি নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্র কিনছে, এ ব্যাপারে সঞ্চয় অধিদপ্তরের কাছে তথ্য নেই। ভালো একটি তথ্যভান্ডার তৈরির চেষ্টাও নেই এই অধিদপ্তরের।

অর্থ বিভাগে পাঠানো এক প্রস্তাবে সঞ্চয় অধিদপ্তর বলেছে, যুগ্ম নামে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং নাবালকের নামে ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা যাবে না। বিক্রির উচ্চসীমাও ৫০ লাখ থেকে কমিয়ে আনতে হবে ৩০ লাখ টাকায়। এ প্রস্তাব কার্যকরে হাত দেয়নি সরকার।
সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগে নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিডিএমসি) নামে একটি কমিটি রয়েছে। কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করছে সঞ্চয়পত্র, এতে ব্যয়ও বাড়ছে। তবে অনেকেই বলছেন, যেহেতু এটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এতে সংস্কার আনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। পাঁচ বছর আগে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের ৬৬ শতাংশ ব্যাংক খাত থেকে আসত, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৪৪ শতাংশে। অন্যদিকে পাঁচ বছর আগে অভ্যন্তরীণ ঋণের ৩৪ শতাংশ আসত সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে, বর্তমানে এই হার ৫৬ শতাংশ।

সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ট্রেজারি বন্ড থেকে অর্থ নেওয়ার সুপারিশ করা হয় সিডিএমসির বৈঠকে। বলা হয়, ট্রেজারি বন্ড অপেক্ষা সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে ৫ শতাংশ বেশি। সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৫ বছর হলেও ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২ থেকে ২০ বছর। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বেশি নেওয়া হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, সরকার কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্থাৎ বেশি সুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ায় দেশের আর্থিক খাত বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছে। এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার অন্যতম উদ্দেশ্য ‘ব্যয় ও ঝুঁকি কমানো’ নীতিরও ব্যত্যয় ঘটছে।

http://www.dailysangram.com/post/351886