৩ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:১৭

সংকট সমাধান না করেই নির্বাচন নিয়ে ইসির তাড়াহুড়ো

দেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো র্বুমান নির্বাচনী ব্যবস্থা পরির্বুনের দাবিতে আন্দোলন করছে। সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন চাচ্ছে। আর তাদের এসব দাবি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনাও চলছে। রাজনৈতিক এ সংকটের এখনো কোনো ধরনের সুরাহা হয়নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করতে তাড়াহুড়ো করছে। আগামী রোববার কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শনিবারই এ বৈঠক করবে ইসি। আর এ জন্য গণকাল শুক্রবারও অফিস করেছেন সবাই। সেই সাথে সাপ্তাহিক ছুটিসহ সকল সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এদিকে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বিরোধীতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সম্মতির কারণেই নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আর নির্বাচনী আইন সংশোধনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করলেও এসব আলোচনার কোন প্রস্তাবই আমলে নেয়নি ইসি। এমনকি এসব প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনার জন্য নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ইসির সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাইলে তাকে তা করতে দেয়া হয়নি।

সূত্র মতে, র্বুমান দশম সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারী। তার আগেই সংসদ নির্বাচন করার বিধান রয়েছে সংবিধানে। তবে ২৮ জানুয়ারী সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরের নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার সুযোগও রয়েছে সংবিধানে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে প্রধানপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট র্বুমান নির্বাচনী ব্যবস্থা পরির্বুন করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন দেয়ার কথা বলছে তারা। আর এ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ নেুাদের সাথে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ সংলাপে রাজনৈতিক সংকট সমাধান হয়নি। কিন্তু বসে নেই নির্বাচন কমিশন। কেউ আসুক বা না আসুক নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য তাড়াহুড়ো করছে ইসি। র্বুমান ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের মনোভাব ছিল সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়েই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। আর এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি পূরণের জন্য তাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছে নির্বাচন কমিশন। এসব আলোচনার সারসংক্ষেপ তৈরী করে নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাবও তৈরী করা হয়েছি। কিন্তু শেষমেষ সবকিছু ভেস্তে দিয়ে শুধুমাত্র ইভিএম পদ্ধতি প্রর্বুনের জন্য আরপিও সংশোধন করা হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে সংসদ অধিবেশন না থাকায় রাষ্ট্রপতিকে অধ্যাদেশ জারি করে এ আইন সংশোধন করতে হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ত্রুটির কারণে ইভিএম পদ্ধতি বর্জন করা হচ্ছে। আর এজন্য অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করার বিরোধীতা করে আসছে। শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই এ পদ্ধতি চালু করতে চায়। ইসি ইভিএম পদ্ধতি চালু করার জন্য আইন সংশোধনের পাশাপাশি ইভিএম ক্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এদিকে গণ ১ নবেম্বর রাষ্ট্রপতির সাথে ইসির সদস্যরা সাক্ষাত করেছেন। সাক্ষাত শেষে সিইসি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ৪ নবেম্বর ইসির বৈঠকে তফসিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু তার আগেই আজ তড়িঘড়ি করে ইসির বৈঠক ডাকা হয়েছে। আর গণকাল শুক্রবারও তারা অফিস করেছেন।
ইসি থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশনে (ইসি) কর্মরত সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন অফিস করতে হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদসহ সবাই গণকাল শুক্রবারও অফিস করছেন।

এর আগে গণ বৃহস্পতিবার ইসির সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সবাই অফিসে যান।
অফিস আদেশে বলা হয়, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ইসি সচিবালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে এবং সাংগঠনিক কাঠামো বহির্ভূত নির্বাচন কমিশনের অধিনস্ত আইডিয়া প্রকল্প, হিসাব রক্ষণ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রকল্প ও সরকারি পরিবহন পুলের গাড়িচালক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগণ স্টাফকে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন এবং অফিস সময়ের পর অফিসে উপস্থিত থেকে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করা হলো।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হলো এবং ইহা অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়।
জানা যায়, শুক্রবার অফিস করলেও সবাইকে জুমার নামাজের বিরতি দেয়া হয়। ইসি সচিব সকালে অফিসে গেলেও নামাজের বিরতির সময় তার বাস ভবনে যান।

এদিকে ইসির তাড়াহুড়ার কারণেই নির্বাচনী আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশোধন করতে হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনেও (ইভিএম) ভোট গ্রহণের বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনা হয়েছে। জাতীয় সংসদ অধিবেশন না থাকায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সংশোধনী আনা হলো। গত বুধবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এতে সই করেন।
এর আগে গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। এর ফলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার করতে পারবে।
আরপিও সংশোধনী অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের আগ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়েছে। এত দিন মনোনয়নপত্র দাখিলের সাত দিন আগে প্রার্থীদের খেলাপি ঋণ পরিশোধ করতে হতো। এ ছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থার পাশাপাশি অনলাইনেও মনোনয়নপত্র দাখিল করা যাবে। সংশোধিত আরপিওতে ইভিএমের অপব্যবহার করলে সর্বনিম্ন তিন বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া ভোট গ্রহণে ইভিএমের ব্যবহার চালুর এ উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। ইসি ৩০ আগস্ট আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করে।
আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচনী আইন সংশোধনে প্রস্তাব পাঠানোর পাশাপাশি ইভিএম ব্যবহারের প্রকল্পটিও গত ১৮ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি।

ওই সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত, বিশ্বাসযোগ্য ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করতে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হবে। এ প্রকল্পে দেড় লাখ ইভিএম মেশিন কিনতে ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ চলতি সময় থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে হলেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সংসদ নির্বাচনে এখনি ইভিএম-এ ভোটগ্রহণের বিরোধীতা করছে।
ইসি জানিয়েছে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তিন ধাপে কেনা হবে। চলতি অর্থবছরে ৫০ হাজার মেশিন কেনা হতে পারে। প্রতিটি ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটের সঙ্গে দুটি করে ব্যালট ইউনিট কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। মেশিনের ওয়ারেন্টি ১০ বছর পাওয়া যাবে।
২০১১ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার শুরু করেন তৎকালীন ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তবে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ কমিশন এ মেশিন ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সিইসি নূরুল হুদার কমিশন পুনরায় নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। এসব মেশিনের গুণাগণ ও কারিগরি দিক উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি সংযোজন করে সংশোধনীও আনা হয়েছে, যা সম্প্রতি কেবিনেটে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/351880