৩ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:১৪

সংলাপে সংকট-উত্তরণ বিবেচনায় ছিল না

গত পরশু সরকারের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বহুল আলোচিত, বহুল প্রতীক্ষিত সাড়ে তিন ঘন্টাব্যাপী সংলাপ অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে বলে স্যোসাল মিডিয়ায় কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যকে নিঃসন্দেহে প্রান্তিক মন্তব্য বলে অভিহিত করা যায়। কিন্তু পর্যবেক্ষকমহল সংলাপ নিয়ে হতাশাই প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংলাপের আলোচনা সাংবাদিক সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বের মতো তাৎক্ষণিক ও রুটিন ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। অথচ সংলাপটি ছিল চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য সব পক্ষেরই পূর্ব প্রস্তুতিসহ গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচনা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাতদফা দাবি ব্যাপকভাবে আলোচিত বিষয় এবং সংলাপের জন্য যে চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া হয়েছিল তাতেও বিষয়টি সুস্পষ্ট ছিল। অতএব আশা করা হয়েছিল সংলাপের রাজনৈতিক পটভূমি সামনে রেখে দাবিগুলোর বিষয়ে যৌক্তিক আলোচনা হবে, কিন্তু তা হয়নি। আলোচনা হতাশার মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে এবং আলোচনার আর সুযোগ নেই এ কথাও মনে করা হচ্ছে।

আলোচনা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন তার প্রাথমিক উপস্থাপনায় বলেছিলেন তাদের সাত দফা দাবির সবগুলোই চলমান আইন ও সংবিধানের আওতার মধ্যেই পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু আলোচনায় দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী এবং তার টিম সমস্যাকে এইভাবে দেখেননি। বিএনপি’র সেক্রেটারি জেনারেল ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়ার রিলিজের প্রশ্নটি উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমাদের বিষয় নয়, বিষয়টা কোর্টের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমরা বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করিনি।’ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বলা যায় এক নম্বর দাবিকে এইভাবেই শেষ করে দেয়া হয়। অথচ রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এই দাবি পূরণে সম্ভব্যতা নিয়ে আলোচনা করা যেত বলে পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বা অন্য বিশেষ প্রয়োজনে জেলে থাকা রাজনৈতিক নেতাকে রিলিজ দেয়ার দৃষ্টান্ত অতীতে রয়েছে। রাওয়াল পিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ ব্যবস্থায় মুক্তি দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও প্যারোলে এবং জামিনের মাধ্যমে জেল থেকে রাজনীতিকরা মুক্ত হয়েছেন এবং রাজনীতিতেও সক্রিয় থেকেছেন। অতএব অভিজ্ঞমহল মনে করছেন রাজনৈতিক সংকটের বিবেচনায় বেগম জিয়াকে জেল থেকে মুক্তি দেবার আইনি পথ ছিল। কিন্তু সংলাপে এইভাবে বিষয়টাকে দেখা হয়নি।

অনুরূপভাবে জেলে আটক থাকা এবং ডজন ডজন মামলার শিকার হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের রিলিজ দেয়া ও মামলা স্থগিত করার বিষয়টিও সংলাপে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের রিলিজ দেয়া এবং মামলা স্থগিতের বিষয়টি বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পাল্টা একটা বিষয় এনে কার্যত তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। পরে বিএনপি’র অপর একজন নেতা আবারো বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে জবাবে এই মামলা ও অ্যারেস্টের তালিকা দিতে বলা হয় এবং বলা হয় যে বিষয়গুলো তদন্ত করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানেও অভিজ্ঞমহল মনে করছেন এই জবাব দেয়ার সময় এই দাবি উত্থাপনের প্রেক্ষাপট, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে রাখা হয়নি। এ ধরনের গ্রেফতার ও মামলার বিবরণ সম্বলিত তালিকা তৈরিতে কতদিন লাগবে এবং সবগুলো বিষয় তদন্ত করতে কতদিনের প্রয়োজন হবে এবং ততদিন নির্বাচন বসে থাকবে কি না এসব বিষয়ে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাকে খুবই হালকাভাবে দেখা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবির সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগও দাবি করা হয়। আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উত্থাপন করা হয়। এর জবাবে বলা হয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে কাকে দায়িত্ব দিবেন। আরো বলা হয় ’৭২ সালের সংবিধানেও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের কথা ছিল না এবং পদত্যাগ করা হয়নি। সেই নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনও যে অংশগ্রহণ করেন সেটাও স্মরণ করে দেয়া হয়। অভিজ্ঞমহলের মতে, এই জবাবের ক্ষেত্রেও এর দাবির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চলমান রাজনৈতিক সংকট বিবেচনা করা হয়নি। বিবেচনা করা হয়নি যে ’৭২ সালের সেই অবস্থা এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংকট এক রকম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা একাধিকবার করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে এরশাদকে পদত্যাগ করিয়ে নির্বাচনকালীন একটি সরকার গঠনের মাধ্যমেই ’৯১ এর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আবার ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়ার অধীনে নির্বাচন মেনে নেয়া হয়নি। অবশেষে সংবিধান পরিবর্তন করে সরকারকে পদত্যাগ করিয়ে ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। ১৯৯০ এবং ১৯৯৬ সালের এই দু’টি ঘটনা সেই সময়ের রাজনৈতিক দাবি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই সংঘটিত হয়েছিল। সেই রাজনৈতিক সংকটই আজ নতুন করে জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছে। অতএব সরকারের পদত্যাগের বিষয়টিকে রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটেই দেখা উচিত ছিল বলে বাস্তবতার দাবি।

আলোচনায় নির্বাচনকালীন সময়ে ম্যাজিস্ট্রেসিক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনে বহুল আলোচিত দাবিটিও উত্থাপন করা হয়। উত্তরে সরাসরিই বলে দেয়া হয়, ‘একানব্বই সালের নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়ন করা হয়েছিল। আপনারা ভুলে গেছেন কিন্তু আমরা ভুলিনি যে তারা মানুষের উপর নির্যাতন চালিয়েছিল। এই জবাবটি পর্যবেক্ষকমহলকে বিস্মিত করেছে। তারা মানুষের উপর কি নির্যাতন করেছিল এ ব্যাপারটি মানুষের সামনে নেই। কিন্তু মানুষের সামনে সুস্পষ্ট যে ’৯১ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, ব্যালট ডাকাতি এবং ভোটকেন্দ্র দখল করে পাইকারি সিল মারার ঘটনা ঘটেনি। তখন একটি সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আসলে বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোট ডাকাতির যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে তার পুনরাবৃতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোধ করার জন্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও দেশের বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়নের দাবি উত্থাপন করছে। কিন্তু সংলাপে দাবিটি এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বিবেচনা করা হয়নি।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট উত্থাপন করে। এই দাবির জবাবে বলা হয়, ‘বিধান অনুসারে সার্চ কমিটির রিকমন্ডেশনের ভিত্তিতেই ইলেকশন কমিশন গঠিত হয়েছে। এর পুনর্গঠন কিভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব নয়।’ এই রুটিন জবাবের মাধ্যমেই ইলেকশন কমিশন পুনর্গঠনের দাবির বিষয়টির ইতি ঘটানো হয়। অথচ অতীতে দাবির প্রেক্ষিতে বিতর্ক এড়াবার জন্যে প্রধান ইলেকশন কমিশনের পদত্যাগসহ ইলেকশন কমিশন পুনর্গঠনের দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু আলোচনা সেদিকে যায়নি। আসলে জাতীয় স্বার্থ এবং জাতির প্রয়োজনটাই বড় কথা। অতীতে জাতির এই স্বার্থ ও প্রয়োজনের সামনে সংবিধানকে বড় করে দেখা হয়নি। কিন্তু এবারের সংলাপে এই মৌল বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে।

সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার মনে করা হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর টিমের একজন আওয়ামী নেতার কয়েকটি কথাকে। একজন বিএনপি নেতা যুক্তি উত্থাপন করেন যে, আওয়ামী লীগের চাপেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। উক্ত আওয়ামী লীগ নেতা এর জবাবে বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমেই সেটা আদায় করা হয়েছিল। পারলে আপনারাও আন্দোলন করে সেটা আদায় করুন।’ পর্যবেক্ষকমহলের কারো কারো মতে গত পরশুর সংলাপে এটাই সার কথা।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনের পথকেই দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। জাতীয় ঐক্যজোটের অন্যতম নেতা আ. স. ম. রব সম্ভবত এই কারণে বলেছেন, দাবি আদায়ে আমাদের আন্দোলন চলবে। অবশ্য মহাজোটের কেউ কেউ এবং সুশীল সমাজের অনেকে সংলাপ ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, সংলাপের সবে শুরু? সংলাপ আরো চলবে। তারা বলেছেন, সরকারের তরফ থেকে সংলাপের পথ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকমহল এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন না। তারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের আর আলোচনার সুযোগ আছে বলে মনে করছেন না। সংলাপের পরে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৮ তারিখের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। আলোচনার টেবিলে প্রধানমন্ত্রী এর চেয়ে হতাশাব্যঞ্জক কথা বলেছেন। উল্লেখ্য, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেন আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে স্বনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। একপর্যায়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কি আলোচনা বন্ধ করে দিচ্ছেন, না তা খোলা থাকছে।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘না দরজা খোলা। যখনই আমরা চাইব আলোচনা হতে পারবে।’ কিন্তু এর পরে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেন তাতে আলোচনার আর সুযোগ থাকে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে আলোচনার ২০টি দরখাস্ত এসেছে। এর জন্য ২০ দিন প্রয়োজন।’ প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন এটাই বাস্তবতা। কিন্তু ২০ দিন পরে কি আলোচনার আর প্রয়োজন থাকবে? না সে আলোচনায় কোনো কাজ দিবে?
এরপরও মনে করা হচ্ছে রাজনীতিতে সব কিছু সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলে আরো সংলাপ হতে পারে, উল্লেখযোগ্য দাবি দাওয়াও পূরণ হতে পারে, নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা পিছাতে পারে এবং চলমান রাজনৈতিক সংকটেরও অবসান ঘটাতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/351877