কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ফাইল ছবি
৩ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, ১০:০৯

আকর্ষণ হারাচ্ছে কক্সবাজার

দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারের তরফ থেকে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কাজের কাজ যে কিছুই হচ্ছে না, এবার কক্সবাজার ভ্রমণে তার প্রমাণই পাওয়া গেল।
বেশ কয়েক বছর পর দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে যা দেখে এলাম তাতে করে রীতিমতো হতাশ হয়েছি।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এক ভাঙাচোরা ও দূষিত কক্সবাজার দেখে ঘরে ফিরেছি! কক্সবাজারের অবস্থা এখন আগের চেয়েও খারাপ। ভাঙাচোরা রাস্তায় চলাফেরা করা দায়।
তার সঙ্গে আছে ড্রেনের দুর্গন্ধ। সিগাল থেকে শুরু করে লাবনী, শৈবাল, প্রবাল ইত্যাদি হোটেল-মোটেলের সামনে দিয়ে যেসব ড্রেন গেছে তার প্রতিটিই ময়লা-আবর্জনায় ভরা এবং তা দুর্গন্ধময়।
অথচ সেখানে জনসমাগম আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। দেশের একশ্রেণীর পর্যটনপিপাসু মানুষ সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। বিশেষ করে যেসব মানুষ পর্যটক হিসেবে বিদেশ যেতে পারেন না, তাদের ভিড়ে কক্সবাজার এখন মুখর হয়ে উঠেছে।
আবার সংখ্যায় কম হলেও সেখানে কিছু বিদেশি পর্যটক এবং দেশের উচ্চবিত্ত মানুষের ভিড়ও বেড়েছে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা এবং ধুলাবালিসহ দুর্গন্ধময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা।
মাত্র কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র উপকূলের মেরিন ড্রাইভ উদ্বোধন করেছেন।
কিন্তু কক্সবাজারের কলাতলী, লাবনী পয়েন্ট, সুগন্ধার মোড় ইত্যাদি এলাকার রাস্তাঘাট, ফুটপাত, ড্রেনের অবস্থা দেখলে মনে হয় না যে, সেখানে একটি প্রথম শ্রেণীর পৌরসভা বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ আছে।
অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এক্ষেত্রে টাকা-পয়সা কম খরচ করা হচ্ছে না। ট্যুরিজম বোর্ড সৃষ্টি করাসহ সরকার সেখানে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছে।
এ অবস্থায় এসব কর্তৃপক্ষ উন্নয়নের নাকি অবনয়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এখন সে প্রশ্নটিরই উত্তর খোঁজা জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ উন্নয়ন বলতে সেখানে কোনো কিছুই চোখে পড়েনি।
পৌর কর্তৃপক্ষ একটি শিশুপার্ক নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছে দেখা গেলেও আর কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। বেসরকারি পর্যায়ে এলোমেলোভাবে নির্মিত যেসব হোটেল, মার্কেট এর আগে দেখে এসেছিলাম, এবারে প্রায় পাঁচ বছর পর ঠিক তেমনটিই দেখে এলাম।
আর সেসব হোটেলেরই একটিতে থেকে দেখে এলাম তাদের সেবার মান, খাদ্যের মান সবই নিুগামী হয়েছে। সেই সঙ্গে বয়সের কারণে হোটেল কক্ষ, টয়লেট ইত্যাদিতেও অবনয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে।

অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র কক্সবাজারের উন্নয়ন না ঘটে অবনয়ন ঘটেছে। সমুদ্রতীর ও হোটেলগুলোতে জনসমাগম বাড়লেও সেসব মানুষের জন্য আনুষঙ্গিক কোনো সুবিধা না বাড়ায় সেখানে এক ধরনের নোংরা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
সাগর পাড়ে ফটোগ্রাফার, হকার, পুলিশের লোকসহ পর্যটকদের অনেকে সমানতালে সিগারেট ফুঁকে চলেছেন। সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকলেই বাতাসে সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পায়ের নিচে তাকালেই বাদাম, চকোলেটের খোসা, পলিথিনসহ বিভিন্ন প্যাকেট, পরিত্যক্ত কলার কাঁদি ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে।

পাঁচ দিন অবস্থানকালে এবারে একদিনের জন্যও সেখানে কোনো স্বেচ্ছাসেবী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দেখা গেল না, যা এর আগে লক্ষ করেছিলাম। হতে পারে কোনো খেলাধুলা বা অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেখানে হয়তো পরিচ্ছন্নতার কাজ চলে।
কিন্তু সেখানে অবস্থানকালে আমরা তেমন কোনো কার্যক্রম দেখতে পাইনি। যা দেখতে পেয়েছি তা হল- বিচ বাইক, ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল, ঘোড়া ইত্যাদির বাড়বাড়ন্ত। অনেক ঘোড়া বিচে দৌড়াদৌড়ি করছে আর সহিষেরা যার-তার কাছে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। বিচ বাইকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
অনেকেই ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল নিয়ে সস্ত্রীক বিচের এ প্রান্ত-ও প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন। এবারে আবার পর্যটন পুলিশের পেট্রলচালিত জিপ গাড়িও দেখে এলাম। ছোট ছোট জিপ ছাড়াও একদিন সন্ধ্যায় পরিবারসহ বড় একটি জিপ বিচের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চলাচল করতে দেখে অবাক হলাম।
পাশে থাকা জাহিদ নামে এক যুবক, যিনি এনজিওদের সঙ্গে দোভাষীর কাজ করেন তার কাছে জানতে পারলাম, ক’বছর আগে পর্যটন পুলিশকে বিচে টহল দেয়ার জন্য ছোট ছোট জিপ গাড়ি দেয়া হয়েছে; কিন্তু এতবড় জিপ গাড়ি নিয়ে ফ্যামিলিসহ টহল দিতে সাধারণত দেখা যায় না।
এতে করে বিচে যে তেল পোড়ানো হয় এবং তাতে বিচের যে নির্মলতা অক্ষুণ্ণ থাকে না সে কথাটি উল্লেখ করে যুবকটি আরও বললেন, এসব ক্ষেত্রে ব্যাটারিচালিত গাড়ি ব্যবহার করলে ভালো হয়। উল্লেখ্য, সকাল-বিকাল-সন্ধ্যায় বাণিজ্যিকভাবে যেসব বিচ বাইক সৈকতে দাপিয়ে বেড়ায়, সেগুলোও পেট্রলচালিত।
তাই বিশ্বের দীর্ঘতম বিচের মান অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে বা সেখানকার আলো-বাতাস নির্মল ও বিশুদ্ধ রাখতে হলে অবশ্যই তেল পোড়ানো সব ধরনের যানবাহন সি-বিচে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ঘোড়ার দাপটও কমানো দরকার। কারণ বিচে ঘোড়া থাকলে সেখানে ঘোড়ার মলমূত্রও থাকবে।
এবারে আবার সেখানে কিছু কুকুরও দেখা গেল। তাছাড়া ফটোগ্রাফার, হকার, ভিক্ষুক ইত্যাদির উপদ্রবও সেখানে কম কিছু নয়! একদিন সূর্যাস্তের আগে বিচে বসে বেশকিছু ভিক্ষুকের উৎপাত দেখতে পেলাম।

পাশে বসা সুইডেন থেকে আগত তিনজন ভদ্রমহিলা, যারা ভারত ও নেপাল ঘুরে কক্সবাজার এসেছেন, তাদের ঘিরে ধরে দু’জন ভিক্ষুক আবদার জানাতে থাকে। ওই দু’জনকে বিদায় করার পর তৃতীয়জন এলে তাকেও একটি বিশ টাকার নোট দেয়া হলে যুবক ভিক্ষুকটি একশ’ টাকা দাবি করে বসল। এসব দেখেশুনে বিদেশি ভদ্রমহিলারা উঠে হোটেলে চলে গেলেন।
সবকিছু দেখেশুনে মনে হল, বর্তমান অবস্থায় বিচ এলাকা ভিক্ষুক থেকে শুরু করে হকার, ফটোগ্রাফার, ঘোড়াচালক, বাইকচালকদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। আর এসব কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেন।

আবার আমাদের দেশের অনেক পর্যটক সেখানে বসে ও হাঁটাচলা অবস্থায় ধূমপান করতেও কসুর করেন না। তাই বিচ এলাকায় ধূমপান বন্ধের বিষয়টিও একান্ত জরুরি।
কিন্তু প্রশ্ন হল, যাদের দিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে সেই পুলিশ নিজেই যদি বিচে দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটতে-চলতে সিগারেট ফোঁকেন, তাহলে বিচ এলাকা ধূমপানমুক্ত হবে এমন চিন্তা বোকামি মাত্র।
বিচ এলাকায় পুলিশি তৎপরতার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় দেখলাম, সেখানে সাইনবোর্ডে পুলিশের ফোন নম্বর দিয়ে মোবাইল কোর্টে অভিযোগ করার পরামর্শ দেয়া আছে।
কিন্তু কথা হল, কোনো ব্যক্তি বা পরিবার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে কি এসব করতে চাইবেন? স্বভাবতই তারা শত কষ্ট হলেও এসব এড়িয়েই চলে আসবেন। এ অবস্থায় পুলিশের কাজ যদি Prevention is better than cure হয় তাতেই পর্যটকদের মঙ্গল।

তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে পুলিশের শরণাপন্ন হওয়া যেতেই পারে। কিন্তু তাই বলে ফটোগ্রাফার, হকার ইত্যাদি শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ যাতে পর্যটকদের বিরক্তির কারণ না হন, সেজন্য পুলিশকেই Preventive ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কক্সবাজারের ট্যুর অপারেটরদের বিষয়ে কিছু বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। আগেই বলা হয়েছে, কক্সাবাজার দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠায় দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের ভিড় দিনের পর দিন সেখানে বেড়ে চলেছে।
আর ট্যুর অপারেটররাও এর সুযোগ নিচ্ছেন। বান্দরবান, টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে ট্যুর প্যাকেজের নামে পর্যটকদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে।

কক্সবাজার থেকে বান্দরবান যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ১৫০০ টাকা নিয়ে যে বাসে উঠানো হচ্ছে, সেখানে পা সোজা করে বসা যায় না। ফলে কষ্টের কারণে অনেকে রাস্তায় নেমে যেতে বাধ্য হন।
আবার একজন পর্যটক হোটেল থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮-১০ জন অটো ড্রাইভার তার পেছনে লেগে যায় এবং তারা কোথাও যেতে না চাইলেও তাদের বিরক্ত করা হয়।
অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে ওই এলাকার পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে কোনো পেশাগত আচরণ লক্ষ করা যায় না। ট্যু
রিস্ট এলাকায় মানুষের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা উচিত সে বিষয়ে ওইসব পরিবহন শ্রমিকের বিন্দুমাত্র শিক্ষাদীক্ষা নেই। আবার সেখানকার বিভিন্ন হোটেলে খাবারের মানও ভালো নয়।
এক দম্পতির অভিযোগ হল, পমফ্রেট ফ্রাইয়ের নামে তাদের পাতে পচা রূপচাঁদা মাছ তুলে দেয়া হয়েছিল। অথচ দুই পিস মাছের বিল ধরা হয়েছিল ১৪০০ টাকা।
আর এভাবে সেখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকরাও মানুষ ঠকিয়ে নিজেরা সমিতি করে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব কারবার দেখার কেউ আছেন বলে মনে হয় না।
কারণ সেখানকার কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাদ্যমান যাচাইয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনোদিন অভিযান পরিচালনা করেছে বলে শোনা যায় না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে লেখাটির পাদটীকায় শুধু এটুকুই বলব যে, দেশের ১৬ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৪ কোটি মানুষকে পর্যটনের স্বাদ গ্রহণ করতে সারা বছর ধরে কক্সবাজার যেতে হয়।
আর সে কারণে সরকারও সেখানকার পরিবেশ উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে ট্যুরিজম বোর্ড এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন অন্যতম। তাছাড়া সেখানে একটি প্রথম শ্রেণীর পৌরসভায়ও আছে। আছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ।
লাবনী পয়েন্টে ট্যুরিজম পুলিশের আকর্ষণীয় অফিসটিও পর্যটকদের জন্য আশার আলোকবর্তিকা বহন করে। কিন্তু সেখানকার রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক কোনো কিছুরই উন্নতি লক্ষ করা গেল না।

এক্ষেত্রে সরকার নতুন নতুন বিভাগ ও পদ সৃষ্টি করে যাদের সেখানে পদায়ন করেছে তাদের ব্যর্থতাই পরিলক্ষিত হল। কারণ গত দুই-তিন বছর, এমনকি পাঁচ বছরের তুলনা টানলেও দেখা যাবে সেখানকার কোনো কিছু আগের তুলনায় উন্নত তো হয়ইনি, বরং পরিবেশের আরও অবনতি হয়েছে।
একমাত্র মেরিন ড্রাইভ ছাড়া কেউ কোনো পার্থক্য দেখাতে পারবেন না। তাহলে সরকারের এত উদ্যম, উদ্যোগ, অর্থকড়ি যাচ্ছে কোথায়? এ অবস্থায় সর্বশেষ যে কথাটি বলব, তা হল, ‘দেশের পর্যটন শিল্প কিন্তু উজ্জ্বল হতে পারছে না’!
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/107510