১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৮

কৃষকের গোলা খালি করে ক্রেতাদের জিম্মি

 

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারি বাজারে গত এক মাসে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এর প্রভাবে খুচরা বাজারে প্রকারভেদে প্রতি কেজি চালের দাম চার থেকে ছয় টাকা বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার আড়ত, চালকল ও খুচরা বাজার থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ নওগাঁ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার আড়ত ও চালকল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ধান ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের কাছে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তাহলে পাইকারির পাশাপাশি খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণ কী? এ প্রশ্নে কৃষকদের পাশাপাশি বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মৌসুমের সময় কম দামে ধান কিনে কৃষকদের গোলা খালি করার পর তা মজুদ করে এখন ক্রেতা ও সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছেন আড়তদার ও চালকল মালিকরা। এভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে চালের দাম বাড়িয়ে বেশি মুনাফা করছেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, বর্তমানে আমন মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় বাজারে ধানের সংকট রয়েছে। যেসব কৃষকের কাছে এখনো ধান আছে তাঁরা বেশি দামে বিক্রি করছেন। পাশাপাশি যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চালকল মালিকরা ধান কিনছেন তাঁদেরও বেশি দাম দিতে হচ্ছে। এ কারণে চালের উত্পাদন খরচ বাড়ছে এবং পাইকারি ও খুচরা উভয় ক্ষেত্রে দাম বেড়ে গেছে।
তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গত বুধবার চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছেন, চালের দাম বাড়িয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহারের পাঁয়তারা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেব না। এ কারণে কোনো অবস্থায় চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে না। ’ মন্ত্রী জানান, মোটা চালের দাম বাড়ার কারণ হচ্ছে—গত বছর এই সময়ে ভারত থেকে প্রায় তিন লাখ টন চাল এসেছিল বিনা শুল্কে। এখন সরকার শুল্ক আরোপের পর এ বছর এই সময় ভারত থেকে চাল এসেছে মাত্র ৩৭ হাজার টন।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে কোনো প্রকার ঘাটতি না থাকার পরও এভাবে দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। মিল মালিক বা ব্যয়সায়ীরা মিলে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজটা করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য সরকারকে চাপে ফেলে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করানো। ’
তাহলে সমাধান কোথায়—এ প্রশ্নে ক্যাব সভাপতি বলেন, ‘আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের চাপে সরকারের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া উচিত হবে না। বরং মিল মালিক বা ব্যবসায়ীদের মজুদ করা ধান-চাল যেন বাজারে নিয়মিত আসে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ’
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে ধান-চালের অন্যতম বড় মোকাম নওগাঁ জেলায় রয়েছে এক হাজার দুই শর মতো চালকল। এসব চালকলে বছরে উত্পাদিত ১৬ লাখ টনের মধ্যে চার লাখ টন চাল লাগে জেলার মানুষের। বাকি চাল সারা দেশে বিক্রি করা হয়।
নওগাঁর চালকলগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, চাল উত্পাদনের জন্য পর্যাপ্ত ধানের মজুদ রয়েছে। চাল উত্পাদনেও কোনো কমতি নেই। এর পরও এ জেলার খুচরা বাজারে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে বেড়েছে চার থেকে ছয় টাকা।
কুষ্টিয়ার চালকলগুলো থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সেখানে খাজনগরে নিবন্ধিত চালকল রয়েছে ৩৬৪টি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার টন চাল দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় এখান থেকে। এখানে প্রকারভেদে প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে চার থেকে পাঁচ টাকা।
নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার মতো বগুড়া, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার চালকল থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ধান ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের কাছে ধানের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও বেড়েছে চালের দাম।
বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষকদের কাছ থেকে আমন মৌসুমে ধান কিনেছেন বিভিন্ন জেলার মৌসুমি ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকরা। এর পাশাপাশি সরকারিভাবে কিছু চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
কৃষকরাও বলছেন, মৌসুমের সময় তাঁদের কাছে যত দিন ধান-চাল ছিল তত দিন দাম কম ছিল। যখনই তাঁদের গোলা খালি হলো তখনই ধান ও চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক আলতু মিয়া বলেন, তিনি ১০ বিঘা জমিতে ধানের চাষ করেছিলেন। নতুন ধান ওঠার আগের সময়টায় যেন সংসারের খাওয়ার জন্য চাল কিনতে না হয় এ পর্যায়ে রেখে তিনি সব ধানই বিক্রি করে দিয়েছেন।
ঝিনাইদহের নতুন হাটখোলা বাজারে চাল কিনতে আসা খলিলুর রহমানের অভিযোগ, ‘কৃষকরা ধান কম দামে বিক্রি করছেন অথচ দিন দিন চালের দাম বেড়েই চলেছে। এটা স্বাভাবিকভাবে হতে পারে না। ধান ব্যবসায়ী, মিল ও চাতাল মালিকরা চালের বাজারে সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়িয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। সরকার যদি এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হবে না। ’
জিম্মি করে দাম বাড়ানোর অভিযোগের জবাবে নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা বলেন, এই সময় নতুন কোনো ধান থাকে না। মৌসুমের সময় যে ধান সংগ্রহ করা হয়েছে তা দিয়েই এখন চাল উত্পাদন হচ্ছে। তবে ধানগুলো গুদামজাত করে রাখতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে বলে এখন খরচটাও বাড়ছে।
জিম্মি করে দাম বাড়ানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দাদা রাইস মিলের মালিক জয়নুল আবেদীন সাধু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মিল মালিকরা ইচ্ছা করে চালের দাম বাড়িয়েছেন এ অভিযোগ ঠিক নয়। ফড়িয়ারা (মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী) কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে রাখে। সেই ধান এখন মিল মালিকরা বেশি দামে কিনছেন। এতে চালের দাম বাড়ছে। ’ তবে গুদামে তিন মাসের চাল উত্পাদনের মতো ধান সব সময়ই মজুদ রাখতে হয় বলে তিনি স্বীকার করেন।
ঢাকার কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের চালের পাইকারি বিক্রেতা মো. আ. আউয়াল তালুকদার জানান, গত এক মাসে প্রকারভেদে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ধান সংগ্রহ করতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়তি লাগছে। এ কারণে ঢাকার খুচরা বাজারে প্রকারভেদে প্রতিকেজি চালের দাম বেড়েছে চার থেকে ছয় টাকা।
পাইকারি চালের বাজারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, পাইজাম গুটি চালের বস্তা পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০০ টাকায়। কেজিপ্রতি দাম পড়ছে ৩৬ টাকা। এ বস্তা মাসখানেক আগেও বিক্রি হতো ১৫০০ টাকায়; যাতে কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩০ টাকা।
পাইজাম গুটির চেয়ে একটু চিকন চালের বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১৯৫০ টাকায়। কেজিপ্রতি দাম পড়ছে ৩৯ টাকা। এ বস্তা আগে বিক্রি হতো ১৭০০ টাকায়, যখন কেজিপ্রতি দাম পড়ত ৩৪ টাকা।
বিআর-২৮ মোটামুটি ভালো মানের চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ২১০০ টাকায়, অর্থাৎ প্রতিকেজি ৪২ টাকা। কিন্তু কয়েক দিন আগে এর বস্তা বিক্রি হতো ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায়; যার কেজি পড়ত ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা।
প্রতি বস্তায় ১০০ টাকা বেড়ে মিনিকেট মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকা। কেজিপ্রতি খরচ পড়ছে ৫০ টাকা যা আগে ছিল ৪৮ টাকা।
নাজিরশাইল চালের ভালোমানের প্রতি বস্তা ২৩০০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৬০০ টাকায়। অর্থাৎ এখন প্রতিকেজির দাম ৪৬ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ টাকায়।
সব ধরনের চালের ক্ষেত্রে এক থেকে তিন টাকা বেশিতে খুচরা বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/02/17/464611