২২ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:২৪

কেলেঙ্কারির জের কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার

২০১০ সালের শেয়ার কলেংকারির পর শতচেষ্টা সত্ত্বেও বাজার ভালো করতে পারেনি সরকার। সে সময় শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব অনেক বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করে। এই অর্থ লুটপাটের সাথে জড়িতদের বিচারের দাবি ওঠে দেশব্যাপী। জড়িতদের চিহ্নিত করতে কমিটি গঠিত হয়। সে কমিটি রিপোর্টে দোষিদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকার বিচার তো দূরের কথা রিপোর্টটি পর্যন্ত আজও প্রকাশ করেনি। সে ঘটনার পর শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন তলানিতে গেছে যে বিনিয়োগ করতে মানুষ ভয় পাচ্ছেন তারা। অর্থ হারানোর ভয় আজও তাদের তাড়া করছে। চরম আস্থাহীনতার ফলে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজারই রয়ে গেছে।
শেয়ারবাজার ভালো হবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এমন ঘোষণাই নির্বাচনের এ বছরে বাজার ভালো যাবে বলে প্রত্যাশা করে ছিল সবাই। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। দেশের শেয়ারবাজারে আবারও চরম আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই কমছে সূচক ও শেয়ারের দাম। নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অব্যাহত দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীর মধ্যে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের বাজারধসের আতঙ্ক আবারও ভর করছে। শেয়ারবাজারের এ দুটি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনাই ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে। বাছবিচার ছাড়াই সব ধরনের শেয়ারের দরপতনে সূচক একের পর এক মনস্তাত্ত্বিক সীমা ভেঙে নিচে নামছে। প্রথম দফায় ডিএসইর সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নামার পর অনেক বিনিয়োগকারী ভেবেছিলেন সূচক হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু উল্টো তা সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমে এসেছে এখন। গত জুনের বাজেট-পরবর্তী সময়ে ডিএসইতে সূচক যতটা বেড়েছিল, গত প্রায় দুই মাসের পতনে তা আগের অবস্থাতেই ফিরে গেছে। ক্রমগত দরপতনে একটু একটু করে পুঁজি কমছে বিনিয়োগকারীদের। ফলে আবারও পুঁজি হারানোর সঙ্কায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। কেউ কেউ দরপতনকে বিনিয়োগকারীদের রক্ত ক্ষরণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। পুঁজি হারানোর শঙ্কার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকটও ভর করেছে।

এক ধরনের দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংকের এ দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও তার খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতেই ২০১৭ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ও লভ্যাংশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক। শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ব্যাংক কোম্পানিগুলোর ঘোষিত লভ্যাংশেও দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। ফলে দেখা দিয়েছে টানা দরপতন।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানিগুলোর খারাপ লভ্যাংশ ঘোষণার কারণেই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তাতে তারা বলছেন, চীনের দুই প্রতিষ্ঠান শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ কনসোর্টিয়ামকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে পাওয়া দেশের শেয়ারবাজারের জন্য বিরাট সুখবর। কিন্তু এ সুখবর আশার পরও শেয়ারবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। আবার সরকার থেকে ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়াতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হলেও ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ায়নি। ফলে শেয়ারবাজারে যে তারল্য সংকট ছিল তা রয়েই গেছে।
বাজারে এ দরপতনের বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে আবারও চরম আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক এ দরপতনের যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। কারসাজির হাতিয়ার হিসেবে কিছু অযৌক্তিক কারণকে সামনে আনা হয়েছে। অনেকেই বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনের জন্য তারল্যসংকটকে দায়ী করছেন। তবে তারল্যসংকট বড় কারণ বলে আমি মনে করি না। গত জানুয়ারিতেও ব্যাংক খাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। তার মানে বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো বেশি ঋণ যাচ্ছে। তাই তারল্যসংকট বাস্তব কারণ নয়, বরং এটিকে বড় কারণ বানানো হচ্ছে বলেই আমার ধারণা।

ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ একেবারেই কমে গেছে। অনেক ব্যাংক তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়ে অন্যত্র খাটাচ্ছে। ব্যাংক খাতে হঠাৎ করে আমানতের সুদ হার বেড়ে যাওয়ায় অনেকে শেয়ারবাজারের পরিবর্তে ব্যাংকে টাকা লগ্নি করছেন। শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক দরপতনে সবচেয়ে বেশি কমছে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাতের শেয়ারের দাম। গত তিন মাসে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে প্রায় ৭৬২ পয়েন্ট। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানোর ঘোষণার পর থেকেই মূলত শেয়ারবাজারে দরপতন শুরু হয়। চাপে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়ালেও শেয়ারবাজারের পতন থামেনি।

জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ক্রমাগত দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাজারে কিছুটা তারল্যসংকটও বিরাজ করছে।

বিনিয়োগকারী মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকি দুর্বলতার কারণেই বাজারে নানাভাবে কারসাজির ঘটনা ঘটে। যেদিন বাজারে বিএসইসির তদারকি শক্তিশালী থাকে সেদিন খুব বেশি সূচক কমে না। বাজারে যদি সংকটই থাকবে তাহলে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটে কীভাবে? আসলে একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বাজারকে নানাভাবে ব্যবহার করছে। আর তাতে বারবার নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন থাকবেই, এটা স্বাভাবিক নিয়ম। এখন শেয়ারবাজারে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে ব্যাংকগুলো ভালো লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টানা দরপতনের জন্য এটি একটি কারণ।

নির্বাচনের বছরে বাজারের এমন খারাপ অবস্থা সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে। ভোটে এ প্রভাব পড়তে পারে এমন শঙ্কাও করছেন তারা। এমতাবস্থায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত বলেন, পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের পরিকল্পনা ঠিক করতে বাজেটের পর বৈঠক করবো। দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কাজ করছে। কিন্তু এটা তাদের কাজ না। পুঁজিবাজারই দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের উৎস হওয়া উচিত। আমাদের একটি ভালো পুঁজিবাজার স্থাপন করতে হবে যা দীর্ঘ মেয়াদী অর্থায়নের উৎস হবে। মুহিত বলেন, আগামী ৭ জুন আমি নতুন অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বাজেট দেয়ার পর শেয়ারবাজার কিছু মেজর প্লেয়ারকে (শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট) ডাকবো। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের লক্ষ্যে আমরা কিছু কারার চেষ্টা করব।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রায় ৯ হাজারে উঠে যাওয়া দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকটি ২০১৩ সালের এপ্রিলে নেমে এসেছিল সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৫০০ পয়েন্টের নিচে। আর এখন এসে সেই সূচক সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ২০১০ সালের পর গত পাঁচ বছরে ৭০টির বেশি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তাতেও সূচকের খুব বেশি উন্নতি হয়নি। বাজারের দৈনন্দিন লেনদেনের অবস্থা আরও খারাপ। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদেন উঠেছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকায়। কমতে কমতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সেটি নেমে আসে সর্বনি¤œ ১০১ কোটি টাকায়। ২০১৪ সালে ডিএসইতে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে দৈনিক গড় লেনদেন আরও কমে নেমে আসে ৪২২ কোটিতে। ২০১৮ সালের ১৭ মে লেনদেন নেমে এসেছে ৪৯২ কোটি টাকায়।

২০১৩ সালের জুলইয়ে সূচক ৪ হাজার ৯০ পয়েন্টে ঠেকেছিল। এরপর ২০১৫ সালে এপ্রিলে ডিএসইর সূচক ৪ হাজার ৯৪ পয়েন্টে নেমেছিল। ২০১৬ সালে ৫ হাজার ৮৮৮ পয়েন্টে নেমে আসে। চলতি বছরেও সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্টে ঘুরপাক খাচ্ছে। বরং এ অবস্থা দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। চলতি বছরের গত ১৭ মে ডিএসই সূচক ৪ হাজার ৪৪৩ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ২০১০ সালে ধসের পরও বিনিয়োগকারীর কাছে এখনো আস্থাহীন দেশের শেয়ারবাজার। এখনো এটি পুঁজি হারানোর বাজার। ভালো-মন্দ বেশির ভাগ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেও লাভের দেখা মিলছে না। তাই বাজারে আসতে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
এ ব্যাপার বিএসইসির চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে অনেক সংস্কার হয়েছে। তবে সেই অর্থে এখনও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মতে, কেলেঙ্কারির ঘটনার পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হলেও এ কমিশনের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। আবার বাজারে ভালো কোম্পানি না আসার কারণে এখনো বাজার একটি দুষ্টচক্রের হাতে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিনিয়োগকারী থেকে ব্রোকারেজ হাউসের মালিক, শেয়ারবাজারে চাকরিজীবী থেকে চাকরিদাতা স্বস্তিতে নেই কেউই। অথচ ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে আস্থা ফেরাতে দেওয়া হয়েছে অনেক প্রণোদনা। তাতে কাজ হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে নতুন যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলোর মান নিয়েও রয়েছে বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্ন। স্বস্তি নেই শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিজীবীদেরও। শেয়ার কেনাবেচা কমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আর্থিক অবস্থা ভালো না। খরচ কমাতে চাকরি ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। চাকরি হারানোর ভয়ে আছেন এসব প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। ফলে আর্থিক খাতের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বাজারের অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/331322