৪ মে ২০১৮, শুক্রবার, ৯:৪২

সীমান্তে ইয়াবা অপ্রতিরোধ্য

এক মাসে টেকনাফে দেড় শ’ কোটি টাকার ইয়াবা উদ্ধার

মহামারী রূপ নিয়েছে মাদক ইয়াবা। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত বিস্তার ঘটেছে নীরব এই ঘাতক ইয়াবা ট্যাবলেটের। সীমান্তে শক্তিশালী সিন্ডিকেট ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের নেপথ্যে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা। যে কারণে কোনোভাবেই এর আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসার এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা।

স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, সাগরে নেমে ইয়াবা ধরা সম্ভব নয়, তবে কারা ইয়াবা পাচারকারী তাদের চিহ্নিত করা একেবারে সহজসাধ্য। ইয়াবা উদ্ধারের পেছনে ছোটার চেয়ে পাচারকারীদের ধরে শাস্তির আওতায় আনা গেলেই এর আগ্রাসন প্রতিরোধ সম্ভব।
ইদানীং সীমান্ত শহর টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা পাচার আগের তুলনায় বহু গুণে বেড়েছে। সীমান্তের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে ঢুকে পড়ছে ইয়াবার বড় চালান। তবে পাচার রোধে থেমে নেই প্রশাসনও। ইয়াবা বহনের বিশেষ কৌশল রীতিমতো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। বিশেষ পন্থায় প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে মরণ নেশা ইয়াবা। দেখে বোঝার উপায় নেই। সীমান্তে কর্তব্যরত প্রশাসনের পৃথক অভিযানে ইয়াবা উদ্ধার তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ইয়াবা উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। তবে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় রেকর্ড সৃষ্টি করেছে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ। বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পৃথক অভিযানে দেড় শ’ কোটি টাকা মূল্যের অর্ধকোটিরও বেশি পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া বেশ ক’টি ইয়াবার চালান আটকের ঘটনায় পাচারকারী আটকের ঘটনাও ঘটেছে।

সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর এপ্রিলে টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা পাচারকালে ২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশের পৃথক অভিযানে ৫২ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে, যার মূল্য ১৫৭ কোটি ৬ লাখ ৭৩ হাজার ১০০ টাকা। পুরো এপ্রিলে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার মধ্যে বিজিবি উদ্ধার করেছে ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৭ পিস ইয়াবা, কোস্টগার্ড উদ্ধার করেছে ২৯ লাখ ১০ হাজার পিস এবং পুলিশের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ১৩ লাখ ৮২ হাজার পিস ইয়াবা। এ ছাড়া টেকনাফে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর উদ্ধার করেছে ২৫ হাজারের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট।

টেকনাফস্থ ২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো: আছাদুদ জামান চৌধুরী জানান, গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে বিজিবি ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৭ পিস ইয়াবা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এসব ইয়াবার মূল্য ২৮ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ১০০ টাকা। তন্মধ্যে মালিকসহ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৭ পিস এবং মালিকবিহীন ইয়াবার পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭ হাজার ৪৯০ পিস। ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে ৬১টি, আসামি ধরা হয়েছে ২৪ জন ও পলাতক রয়েছে দুইজন।
এ দিকে গেল এপ্রিলে সীমান্তে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ইয়াবা জব্দ করেছে কোস্টগার্ড। কোস্টগার্ডের ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় ছয় লাখ ২০ হাজার ও ছয় লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবার দু’টি বড় চালানও ছিল। এ ছাড়া গত মাসে এ বাহিনী ২৯ লাখ ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এসব ইয়াবার মূল্য ৮৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

কোস্টগার্ডের তথ্য মতে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে ও বাংলা চ্যানেল পথে পাচারকালে ইয়াবার বেশির ভাগ চালান জব্দ হয়। গত ৩০ এপ্রিল তিন লাখ ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় বোটসহ চার পাচারকারীকে আটক করে কোস্টগার্ড। তবে ইয়াবা পাচার রোধে সাম্প্রতিক সময়ে সাগরে কোস্টগার্ডের তৎপরতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন্স স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফয়সাল বিন রশিদ জানান, সাগর ও নৌপথ ব্যবহার করে পাচারকারীরা ইয়াবা পাচার করে থাকে। ইয়াবা পাচার রোধে কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে সাগরে সর্বোচ্চ সতর্কতাসহ টহল জোরদার করা হয়েছে। যার ফলে গত মাসে কোস্টগার্ড সাগর পথে পাচারের সময় ইয়াবার ছয়টি বড় চালান আটক করতে সক্ষম হয়।
কোস্টগার্ডের ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সাগর পথে ইয়াবার পাচার বন্ধ করতে কোস্টগার্ডের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারকারীদেরকেও ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাবে কোস্টগার্ড।

এ দিকে গত মাসে ইয়াবার চালান উদ্ধারে রেকর্ড গড়েছে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ। টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ গত এপ্রিলজুড়ে পৃথক অভিযানে ১৩ লাখ ৮২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া চলতি মাসে পুলিশের একক অভিযানে পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার পিস ইয়াবার বড় চালানসহ কায়ুকখালী ঘাট থেকে ট্রলারসহ তিন লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার এবং সর্বশেষে গত ৩০ এপ্রিল রাতে ছোলা বোঝাই ট্রাক থেকে চার লাখ ৫৫ হাজার পিস ইয়াবার বড় চালান আটকের ঘটনাও ঘটে।

টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রনজিত কুমার বড়–য়া জানান, ইয়াবার প্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী অতীতের চেয়ে এখন বেশি তৎপর। গত মাসে মডেল থানা পুলিশ একক অভিযান চালিয়ে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ইয়াবার চালানসহ কয়েকটি বড় চালান উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ইয়াবা পাচার বন্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পাচারকারী ও ইয়াবাকারবারীদের ধরতেও পুলিশের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

কোস্টগার্ড সেন্টমার্টিন্স স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফয়সাল বিন রশিদ জানান, মিয়ানমার থেকে পাচার হওয়া ইয়াবার চালানগুলো ধরতে কোস্টগার্ড সব সময় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এর আগে কোস্টগার্ডের অভিযানে কয়েকটি বড় চালানও জব্দ করা হয়েছে। সাগরে ইয়াবা পাচারকারীদের যারা জেলে সেজে মাছ ধরার বাহানা দিয়ে ইয়াবা পাচারে সম্পৃক্ত হচ্ছে তাদের ধরতেও বাহিনীর পক্ষ থেকে তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/315430