৩ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:৩০

বজ্রপাতে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল

আরো ৪৮ ঘণ্টায় নিহত ১৯


বৈশাখ মাসের কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে সাথে বজ্রপাত নিত্য নৈমত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। গত ৪৮ ঘন্টায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। বজ্রপাতে নিহতদের মাঝে সুনামগঞ্জের চারজন, গাইবান্ধা, সিলেট, হবিগঞ্জ ও বগুড়ার দুই জন করে এবং রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, শেরপুরের একজন রয়েছেন।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীর পবায় বজ্রপাতে আমবাগান পাহারাদার মাজাহার হোসেন (৬০) নামে একজন বৃদ্ধ নিহত হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছে ফারুক হোসেন (২৮) নামে আরো একজন। তাকে পবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে বৃষ্টির সময় পবা উপজেলার শিতলায় গ্রামে হঠাৎ বজ্রপাত হলে এ ঘটনা ঘটে। আহত ফারুক নিহত ব্যক্তির ছেলে বলে জানা গেছে।

পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, মোজাহার ও তার ছেলে ফারুক শিতলায়ের আকবর আলীর আমবাগান পাহারা দিচ্ছিলেন। এ সময় বজ্রপাতে মোজাহার মারা যান। আহত অবস্থায় ফারুককে হাসপাতালে ভর্তি করে স্থানীয় লোকজন। নিহতের দাফন সম্পন্ন করার জন্য ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। হবিগঞ্জ জেলা সংবাদাতা জানান, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে বজ্রপাতে দুই কৃষক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো একজন আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- উপজেলা সদরের বাসিয়াপাড়া এলাকার তৈয়ম উল্লার ছেলে করিম উল্লা (৬৫) ও বড়ইউড়ি গ্রামের তাহির মিয়ার ছেলে শাহীন মিয়া (২৫)। আহত জাহেদ মিয়া (৩০) বড়ইউড়ি গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে। এছাড়াও নবীগঞ্জ উপজেলার রোকনপুর হাওরে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে আব্দুল জব্বার (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আব্দুল জব্বার নবীগঞ্জ উপজেলার আশ্বাস উল্লার ছেলে।
সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরাঞ্চলে ধানকাটার সময় বজ্রপাতের আঘাতে সানোয়ার হোসেন(৩০) নামে এক কৃষক নিহত ও রফিকুল ইসলাম (৪৫) নামে আরেক কৃষক আহত হয়েছেন।গতকাল সকালে উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের ছিন্নারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। সানোয়ার ওই গ্রামের আব্দুল হকের ছেলে ও আহত রফিকুল একই গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে। মনসুরনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জানান, সকালে বৃষ্টির মধ্যে সানোয়ার ও রফিকুল বাড়ির পাশে মাঠে ধান কাটতে যান। এ সময় বজ্রপাতের আঘাতে তাদের শরীর ঝলসে যায়। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সানোয়ারকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত রফিকুল বর্তমানে চিকিৎসাধীন।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের হাড়ভাঙ্গা গ্রামে বজ্রপাতে সোখিনা বেগম (৪৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত সোখিনা বেগম ওই গ্রামের হেলাল মিয়ার স্ত্রী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের চাঁনভাসা এলাকায় গতকাল সকালে বজ্রপাতে সোনাদ্দি (৪০) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত সোনাদ্দি একই ইউনিয়নের শুকনাপাড়া গ্রামের এরফান আলীর ছেলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ওসি মঞ্জুর রহমান জানান, সোনাদ্দি তার শ্বশুরবাড়ি চাঁনভাসা এলাকায় জমিতে ধান কাটছিল। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বজ্রপাতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।

নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর মান্দায় বজ্রপাতে নাজমুল হক মÐল (২৫) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার মহানগরগ্রামের মাঠ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। নাজমুল উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়নের মহানগর নিচপাড়া গ্রামের সাইফুদ্দিন মন্ডলের ছেলে। স্থানীয় সূত্র জানায়, নাজমুল হক তার বাড়ির পাশের মাঠে ধান কাটার কাজ করছিলেন। দুপুরের দিকে আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ঢেকে যায়। নাজমুল ধান কাটা কাজ রেখেই বাড়ির দিকে আসছিলেন। হঠাৎ বজ্রপাত হলে মাঠের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। মান্দা থানার ওসি আনিছুর রহমান বজ্রপাতে নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় বজ্রপাতে মো. আলী আকবর (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আলী উপজেলার দামপাড়া ইউনিয়নের শেখ নবীনপুর গ্রামের নীলু মিয়ার ছেলে।

সুনামগঞ্জে জেলা সংবাদদাতা জানান, পৃথক স্থানে বজ্রপাতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বজ্রপাতের এ ঘটনা ঘটে। মৃতরা হলেন- সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ (৪৫), জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাক ইউনিয়নের খোজারগাঁও গ্রামের কমলাকান্ত তালুকদার (৬০), বিমখালি ইউনিয়নের কলকতা গ্রামের হিরণ মিয়া (৩৫), বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের মেরুয়াখলা গ্রামের সাইদুর রহমানের ছেলে আলম মিয়া (৫০)। সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শহিদউল্লাহ সদর উপজেলার মোল্লা পাড়া ইউনিয়নে বজ্রপাতে নিহতের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

গাইবান্ধায় জেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধায় নিহতেরা একই পরিবারের সদস্য। বিলে ধান কাটতে গিয়ে নিহত হয়েছেন মা ও ছেলে। নিহতেরা হলেন সাঘাটা উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের আবদুস সালামের স্ত্রী বিলকিস বেগম (৩৫) ও ছেলে সোহেল রানা (১৮)। সকাল ৮টার দিকে বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎ বজ্রপাতে তারা ঘটনাস্থলেই মারা যান। সোনাতলা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
শেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, শেরপুর জেলার সদর উপজেলার বউলি বিলে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন এক কৃষি শ্রমিক। ধলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রহিজ উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় আহত দুইজনকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে, সিলেটের কানাইঘাটে বজ্রপাতে নিহত দুই জনই কিশোর। গত মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের বড়াই গ্রামের পাশের হাওরে বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু হয়। বড়াই গ্রামের করিম আলী ওরফে বতাইয়ের ছেলে তোফায়েল আহমদ তামিম ও ফখরুল ইসলামের ছেলে সালমান আহমদ হচ্ছে নিহত দুই কিশোর। কানাইঘাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল আহাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বগুড়ার মেঘাখাদবো গ্রামের তবিবর শেখের ছেলে তমিজুর রহমান (৪৭) ও অজ্ঞাত আরও এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ পরিদর্শক মিজানুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

বজ্রপাতে সতর্কতা
বজ্রপাত নিয়ে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর ২০টি জরুরি নির্দেশনা দিয়েছে। নির্দেশনাগুলো হলো :
১. বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।
২. প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দÐ স্থাপন নিশ্চিত করুন।
৩. খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যান।
৪. কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান।
৫. খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে।
৬. ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
৭. ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে।
৮. বজ্রপাতে আহতদের বৈদ্যুতিক শকের মতো করেই চিকিৎসা দিতে হবে।
৯. এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়। এই সময়ে আকাশে মেঘ দেখা গেলে ঘরে অবস্থান করুন।
১০. যত দ্রæত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
১১. বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকবেন না এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন।
১২. ঘন-কালো মেঘ দেখা গেলে অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে বের হতে পারেন।
১৩. উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, তার, ধাতব খুঁটি ও মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দূরে থাকুন।
১৪. বজ্রপাতের সময় জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করুন।
১৫. বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকবেন না।
১৬. কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকুন।
১৭. বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।
১৮. বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ুন।
১৯. বজ্রপাতের সময় গাড়ির মধ্যে অবস্থান করলে, গাড়ির থাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না। সম্ভব হলে গাড়িটিকে নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
২০. বজ্রপাতের সময় মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/129245