৩ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:২৪

রাজধানীতে পানিবদ্ধতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন

গেল রোববার (২৯ এপ্রিল) সকাল ৮টার দিকে আকাশ আঁধার করে রাজধানীতে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী। আবহাওয়া অফিস বলেছে, ঝড়ের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭৩ কিলোমিটার। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ঢাকায়। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ বলেন, ঝড়-বৃষ্টির এই প্রবণতা চলবে আরও কয়েক দিন। এই সময়ে প্রতিদিনই ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক ঘন্টার এই বৃষ্টিতেই কোমর পরিমাণ পানি জমে রাজধানীর অলি-গলিসহ প্রধান সড়ক গুলোতে। প্রতিবছরই বৃষ্টির পানিতে রাজধানী তলিয়ে গেলেও কেউই এর জন্য এককভাবে দায়িত্ব নিতে চায়না। পানিবদ্ধতা নিরসনে নিয়োজিত সংস্থাগুলো একে অপরের উপর দোষ চাপিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে। বিশেষ করে ঢাকা ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, ঢাকা জেলা এর মধ্যেই টানাপোড়েনটা বেশী। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে পানি নিষ্কাশনের ২৬টি খালই দখল ও ভরাট হয়ে আছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো শুধু খাল দখলের তালিকা করে দায় সেরেছে। ৯টি বড় বক্স কালভার্ট খুলে আগের অবস্থায় খালগুলো নেওয়াও সম্ভব হয়নি। ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণ ও পুরনো নর্দমা পরিষ্কারের কার্যকর কর্মসূচিও তেমনভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না।

পানিবদ্ধতার বিষয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, মূলত তিনটি কারণই পানিবদ্ধতার জন্য যথেষ্ট। সেগুলো হচ্ছে, প্রথমত: বৃষ্টি পানি ধরে রাখার জন্য ১২ শতাংশ জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু রাজধানীতে যেসব পুকুর, ডোবা, খাল বিল ছিল সেগুলো এখন আর নেই। সবই দখলে চলে গেছে। পানি ধওে রাখার জন্য বর্তমানে মাত্র ২ শতাংশ জায়গা রয়েছে। দ্বিতীয়ত: ঢাকা শহরে এখন মাটি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কোথাও খালি জায়গা নেই। পুরো রাজধানীটাই ইট আর কনক্রিটে ঢাকা। বৃষ্টির পানি যে প্রকৃতিগত ভাবে মাটির নীচে যাবে তা সম্ভব নয়। ফলে পানি সরতে পারেনা। এবং শহরের যে নি¤œাঞ্চলগুলো ছিল সেগুলো এখন আর নেই। প্রভাবশালীরা সেগুলো ভরাট করে অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে। ফলে বৃষ্টির পাসি সরতে না পেওে লোকালয়ে ডুবে পড়ে। এতে পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। তিনি জানান, টিপটিপ বৃষ্টি হলে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন একটানা ৫০ মিলি মিটার বৃষ্টি হবে তখন কারোরই কিছু করার থাকেনা। চলতি বর্ষা মওসুমেও রাজধানীতে পানিবদ্ধতা থাকবে বলে তিনি জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াসার এমডি বলেন, এক সময় রাজধানীতে ৬৫টি খাল ছিল। এখন মাত্র ২৬টি খাল বিদ্যমান। অন্য খালগুলো কোথাও গেলো, তা দেখার কেউই নেই। তিনি বলেন, খাল দখলমুক্ত করার পর আবারো দখল হচ্ছে এটি ঠিক। কিন্তু কারা দখলে রাখছে সেটি দেখার বিষয়। আমাদের সেখানে কিছুই করার থাকেনা। তবে আমরা আমাদের ক্ষমতার মধ্যে যা দরকার তাই করছি। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে ২৬টি খালের পাড় বাঁধাই করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়। প্রথমে ৮টি, এরপর ৫টি মোট ১৩টি খালের পাড় বাঁধানো হয়। খালের পাড় বাঁধানোর কাজ শেষ না করলে উচ্ছেদ করে কোন লাভ হবে না। আর খাল দখল যারা করছেন তারা অনেক উপর মহলের লোক। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা যে কোন একটি সংস্থার উপরই ন্যাস্ত থাকা উচিৎ। একাধিক সংস্থা জড়িত থাকায় ঠিক মতো তদারিক হয়না।

পানিবদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি বলেন, রাজধানীর পানিবদ্ধতার জন্য ঢাকা ওয়াসাই অনেকাংশে দায়ী। তিনি বলেন, রাজধানীর খাল পরিস্কারসহ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতি কেবল ওয়াসাই করে থাকে। অন্য সংস্থাগুলো এর সাথে তেমন বেশী জড়িত নয়। তিনি বলেন, ওয়াসা তাদের দায়িত্বগুলো সেভাবে পালন করেনা। ময়লা আবর্জনা পরিস্কার না করায় রাজধানীতে মশার উৎপাদনও বাড়ছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, রাজধানীর খাল ও ড্রেন পরিষ্কার করার জন্য ঢাকা ওয়াসাকে অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো চিঠির উত্তর দিচ্ছে না। আমরা সিটি কের্পারেশনের পক্ষ থেকে সাধ্যমত চেষ্টা করছি। কিন্তু ওয়াসা সেভাবে সহায়তা করেনা। এর ফলে চলতি বর্ষা মওসুমে যেমন পানিবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি মশার দৌরাত্ম্যও নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, দায় নিয়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের টানাপড়েন, একক ও সমন্বিত কর্তৃপক্ষ না থাকায় রাজধানীবাসী পানিবদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনের ২৬টি খাল আবারো দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর শুধু খাল উদ্ধার আর পরিস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে সেগুলো ভেস্তে যায়। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো শুধু খাল দখলের তালিকা করে দায় সারছে। ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণ ও পুরনো নর্দমা পরিষ্কারের কার্যকর কর্মসূচিও তেমনভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না।

গেল বছর মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর পানিবদ্ধতা দূর করতে বক্স কালভার্টগুলো খুলে দিয়ে এগুলোর ওপর দিয়ে উড়াল সেতু করা যায় কি না তা ভেবে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধারের নির্দেশও দিয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও এসব কাজে সমন্বয় ও অগ্রগতি চোখে পড়ে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই সিটি কর্পোরেশনে পানিবদ্ধতা নিরসনে সহায়ক ও সড়ক উন্নয়নে দুই হাজার ৬১২ কোটি টাকার সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের সুফল দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলেই মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও অলিগলিতে উপচে পড়ে পানি। দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার সড়ক দফায় দফায় ভেঙে পড়ছে। পিচের সড়কে তিন দিন পানি জমে থাকলেই তা ভেসে যায়।

সূত্র মতে, গেল বছর রাজধানীতে দফায় দফায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেসব স্থানে হাঁটু পানি দেখা যেত, এবার কোমর পানিতে সেসব স্থান ডুবেছে। জানা গেছে, খাল রক্ষণাবক্ষণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা হাত গুটিয়ে বসে আছে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে। এ অবস্থায় যতবার পানিবদ্ধতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, ততবারই শুধু আশ্বাস বাণী শুনতে হয়েছে রাজধানীবাসীর। এবারো বলেছে, টানা বৃষ্টি হলে তাদের কিছুই করার নেই।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার সার্বিক সমস্যা সমাধানে একটা সুপার অথরিটি থাকা দরকার। সুশাসন, পরিচালন ও সমন্বয়ের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষমতার কর্তৃপক্ষ হবে এটি। পানিবদ্ধতা নিরসনে কী কী বিষয় প্রাধান্য পাবে তা এ কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে, সমন্বয় করবে।
ডিএসসিসির এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, খাল উদ্ধার, পরিষ্কার ও ড্রেন পরিষ্কার করা পুরোপুরি ওয়াসার দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওয়াসার নীতিনির্ধারিত মহলকে এ ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এখন তারা কতটুকু করছে, তা দেখবে সরকার। আমরা ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ওয়াসা ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে পত্র দিয়ে খাল উদ্ধারের জন্য অবহিত করেছি।
সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরের পানিবদ্ধতা কার ব্যর্থতার কারণে হলো এটা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেসব খাল-জলাশয় ছিল, সেটা ভরাট করা হয়েছে। এসব দেখার দায়িত্ব সবার। এর সাথে জেলা প্রশাসক, ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক সবাই জড়িত। তবে ওয়াসার দেখার দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে বেশী। তারা সেভাবে দেখছেনা। তাদের উদাসীনতা ও ব্যর্থতায় খালগুলো দখল ও ভরাট হয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর বৃষ্টির পানি উন্মুক্ত ড্রেন (সারফেস) দিয়ে মাটির নিচের পাইপ ড্রেন হয়ে খাল দিয়ে নদীতে চলে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে উন্মুক্ত ড্রেনের অর্ধেকাংশের দেখভাল করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। বাকিটা ওয়াসা। এ ছাড়া অন্যান্য পাইপ ড্রেন ও স্যুয়ারেজ ড্রেন দেখার দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু ওয়াসা বরাবরই অভিযোগ করে সিটি কর্পোরেশনের সারফেস ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ থাকে। যে কারণে পানি পাইপ ড্রেনে যেতে পারে না। একইভাবে উল্টো অভিযোগ করে সিটি কর্পোরেশন। তারা বলে ওয়াসার পাইপ ড্রেনগুলো কখনও পরিষ্কার করা হয় না। এ জন্য পানি নামতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, পানিবদ্ধতা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসা ব্লেম গেম (পারস্পরিক দোষারোপ) খেলছে। ওয়াসাকেও পুরো দায় দেওয়া যায় না। আর সিটি কর্পোরেশনকেও দেওয়া যায় না। এখানে যতদিন পর্যন্ত পুরো ড্রেনের দায়িত্ব মেয়রদের কাঁধে না যাবে ততদিন পর্যন্ত এ সমস্যা থাকবেই। এর সঙ্গে সাতটা মন্ত্রণালয় আছে। এখানে সমন্বয়হীনতারও ব্যাপার আছে।
একটি অনুষ্ঠানে সাবেক মেয়র (উত্তর) মরহুম মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে যে খালগুলো আছে, তারা পানিবদ্ধতা দূর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এই খালগুলো বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দখল করে ভরাট করছে। খালগুলো দখলমুক্ত করার দায়িত্ব ঢাকা জেলা প্রশাসনের, পানি প্রবাহ দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। সিটি কর্পোরেশন এখানে বড়জোর দুই পাশের ময়লা পরিষ্কার করা ও ফুল লাগানোর দায়িত্ব পেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে মোট ৫৬টি সরকারি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে আবর্জনা পরিষ্কার ও গাছ লাগানো ছাড়া বাকি কোনো কাজে সিটি কর্পোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সবগুলো সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয় আনতে না পারলে শহরের সমস্যার সমাধান হবে না।
সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীর গলি কিংবা রাজপথ অনেক জায়গায় পানি জমে যায়। থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টিতেও ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। রাস্তায় গণপরিবহনের উপস্থিতিও কমে যায়। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ সিস্টেমকে একক কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। সংশ্লিষ্ট ১৪টি সরকারি সংস্থাকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে মহাপরিকল্পনা তৈরি এবং সে অনুযায়ী কাজে নেমে পড়তে হবে। এছাড়া পানিবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে জনগণের সম্পৃক্ততা এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সমন্বয়হীনতাই রাজধানীর পানিবদ্ধতার বড় কারণ। আইন না মেনে অবৈধ দখল এবং জলাশয় ভরাটও এজন্য দায়ী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্যুয়ারেজ কিংবা ড্রেনেজ সিস্টেম নষ্ট করে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, বক্স কালভার্ট ও ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার না রাখা এবং নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেও এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এই সমস্যা নিয়ে বহু আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। সম্ভাব্য সমাধানও ঠিক করা আছে। তবে সমাধানের জন্য সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/328948