৩ মে ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:২০

শুদ্ধ চৈতন্য কোনো হেঁয়ালি বিষয় নয়

বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রযুক্তির উল্লম্ফনে বেশ অস্থির সময় কাটছে মানুষের। শুধু গতি নয়, অতি গতির কারণে জীবন ও জগৎ নিয়ে ভাবা তো দূরের কথা, মানুষ তো এখন নিজের কাছেই নিজে অপরিচিত। এমন শূন্যতার মধ্যে মানুষ শান্তি খুঁজে পাবে কেমন করে? এমন দার্শনিক ভাবনাকে কেউ কেউ হেঁয়ালি মনে করে অবজ্ঞা করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দার্শনিক ভাবনাকে অবহেলা করতে করতে আমরা শুধু ব্যক্তি মানুষকে নয়, আমাদের সমাজ এবং বিশ্ব ব্যবস্থাকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছি। সম্বিত ফিরে পেলেতো আমরা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠতাম, কর্মসূচি নির্ধারণ করতাম এবং মানব জাতিকে বাঁচাবার জন্য নেমে পড়তাম নতুন এক অভিযাত্রায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তেমন চৈতন্য আমাদের মধ্যে এখনও সৃষ্টি হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে গাড়ি হামলার ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। হঠাৎ একটি গাড়ি সড়কে কিংবা ফুটপাতে একের পর এক মানুষ হত্যা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। রাগ ও ক্ষোভ থেকে, বিদ্বেষ থেকে এবং বিভ্রান্তি ও প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে এসব ঘটনা ঘটছে বলে আমরা গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারি। অনেক সময় এইসব খবরে আমরা স্বার্থান্বেষী মহলের চিহ্নিতকরণ প্রবণতাও লক্ষ্য করে থাকি। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে, সংবাদ সবসময় সত্যের সন্ধান দেয় না, দার্শনিক বিশ্লেষণ তো দূরের কথা। কানাডার টরন্টোতে গত ২৩ এপ্রিল সোমবার গাড়ি হামলার এক ঘটনা ঘটে। হামলায় হতাহতদের বেশিরভাগই নারী। প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ থেকে পুলিশ ধারণা করছে, নারীবিদ্বেষ থেকে ওই হামলা চালানো হয়েছে। সন্দেহভাজন হামলাকারীর নাম অ্যালেক মিনাসিয়ান (২৫)। গত ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে মিনাসিয়ানকে টরন্টোর আদালতে হাজির করা হয়। তার মধ্যে কোন ভাবাবেগ দেখা যায়নি। আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হয়। তার বিরুদ্ধে ১০টি হত্যা ও ১৩টি হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হন।

প্রশ্ন জেগেছে, কেন এই গাড়ি হামলা? ঘটনার প্রধান তদন্তকারী গ্রাহাম গিবসন বলেন, হামলার শিকার বেশিরভাগই নারী। ভরদুপুরে টরন্টোর ব্যস্ত রাস্তায় পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার কিছু সময় আগে মিনাসিয়ান ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। সেখানে দুর্বোধ্য ভাষায় একটি বার্তা আছে। মিনাসিয়ান তার ফেসবুক পোস্টে এলিয়ট রজার (২২) নামের এক ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। আর লিখেছেন, ‘ইনসেল বিদ্রোহ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমরা সব চ্যানওস্টেসিসকে উৎখাত করবো।’ আর এগুলো বিশ্লেষণ করতে গিয়েই কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার দশা হয়েছে। মিনাসিয়ান যার প্রশংসা করেছেন সেই এলিয়ট রজার ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইসলাভিসতায় গুলী চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের নারীবিদ্বেষী। হতাশ ঐ ব্যক্তি নিজের নিঃসঙ্গতার জন্য সব নারীকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এলিয়ট রজার একজন স্বঘোষিত ‘ইনসেল’ ছিলেন। ইনসেলরা বিশ্বব্যাপী পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী এবং নারীবিদ্বেষী। হতাশা থেকে যে নারীবিদ্বেষ, তা কি জীবনদর্শন তথা জীবনদৃষ্টির সাথে জড়িত নয়? তাই মানব জাতিকে বিপর্যয় থেকে বাঁচতে এখন প্রয়োজন সঠিক জীবনদর্শন তথা শুদ্ধ চৈতন্য।

বহুদিন পর মানুষ একটি কাক্সিক্ষত চিত্র দেখতে পেল। দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের দিকে হেঁটে এগিয়ে গেলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন। মুখে হাসি। দাঁড়ালেন দুই দেশকে ভাগ করা সামরিক সীমান্তরেখার উত্তর কোরিয়া অংশে। অন্য পারে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। সীমান্তরেখার দুই পারে দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন তারা। মুন উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানালেন কিমকে। কিম সীমান্তরেখা পাড়ি দিয়ে পা রাখলেন দক্ষিণের মাটিতে। আর এর মধ্যদিয়ে রচিত হলো নতুন এক ইতিহাস। উল্লেখ্য যে, কোরীয় যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ৬৫ বছরের মধ্যে ২৭ এপ্রিল শুক্রবার প্রথমবারের মতো উত্তরের কোন নেতার পা পড়লো দক্ষিণে। সিউল থেকে রয়টার্স ও এএফপির বর্ণনায় এমন চিত্রই উপহার পেলাম আমরা।

১৯৫০ সালে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে কোরীয় উপদ্বীপে। তিন বছর যুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়। সেই থেকে দেশ দুটি যুদ্ধ বিরতিতেই ছিল, তবে আনুষ্ঠানিক কোন শান্তিচুক্তি হয়নি। বরং বৈরিতা ক্রমেই বেড়েছে। মাঝে মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। দক্ষিণ কোরিয়াকে সুরক্ষা দিতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে মোতায়েন রেখেছে বিপুলসংখ্যক মার্কিন সেনা ও যুদ্ধ সরঞ্জাম। আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে একঘরে হয়ে পড়ে উত্তর কোরিয়া। নিজেদের সুরক্ষার অজুহাতে তখন দেশটি পারমাণবিক কর্মসূচি শক্তিশালী করে। বিশেষত ২০১১ সালে কিম জং-উন কমিউনিস্ট শাসিত উত্তর কোরিয়ার শাসক হওয়ার পর পারমাণবিক কর্মসূচি আরও জোরদার করেন। বিশ্বনেতারা যত বেশি কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাতে থাকেন, কিম ততবেশি আগ্রাসী হয়ে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, যে কোন সময় বড় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তবে আশার কথা হলো, সব বৈরিতা আর যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অতীতের বিষয় করে গত ২৭ এপ্রিল দুই দেশ ঘোষণা করলো- আর যুদ্ধ নয়, বরং কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করতে দুই দেশ একজোট হয়ে কাজ করবে। এমন শুদ্ধ চৈতন্যইতো মানুষের কাম্য।

উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ ঘোষণায় বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ খুশি হয়েছে। কারণ মানুষতো শান্তি চায়। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোও শান্তির কথা বলে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় মোড়লীপনাও করে। তবে শান্তি আর প্রতিষ্ঠা পায় না। এর বড় প্রমাণ সিরিয়া। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ ঘোষণায় আনন্দ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনও। আমরা জানি, এই ত্রয়ীরাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে শান্তির পক্ষে অবস্থান নিলে কোরীয় উপদ্বীপে শান্তির সুবাতাস বইতে থাকবে। এমনটি হলে বর্তমান অশান্ত বিশ্বের বাতাবরণেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে পারে।

http://www.dailysangram.com/post/329018