১ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৭:৪৮

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

-ডঃ মোঃ হাবিবুর রহমান

আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন, وَآتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ “আর তোমরা যা চেয়েছ তিনি তার প্রত্যেকটি থেকে তোমাদের সকল চাহিদা পুরণ করেছেন। এবং যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অধিক অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইবরাহীম- ৩৪)

একমাত্র আল্লাহ তাআলাই পারেন মানুষের সকল চাহিদা পুরণ করতে, তিনিই পারেন সকলের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। রাসূল (সা.) যে সমাজে এসেছিলেন সে সমাজের মানুষের কোন অধিকার ছিলোনা ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই নীতিতে সমাজ পরিচালিত হতো। রাসূল (সা.) নবুয়াত প্রাপ্তির পরে আল-কুরআনের নির্দেশিত পন্থায় সমাজের সকল মানুষের অধিকার প্রতিষ্টা করলেন। যে নারী, শিশু, দূর্বল, অসহায় ও শ্রমিকের কোন অধিকার দেওয়া হতোনা তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিলেন। একমাত্র ইসলামী জীবনাদর্শই পারে শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার ফিরিয়ে দিতে। নিম্নে আল-কুরআন ও আল-হাদীসের আলোকে শ্রমিকের অধিকার ও মালিকের করনীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

পৃথিবীর সকল মানুষই শ্রমিক :
আল-কুরআনে সকল মানুষকেই শ্রমিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে একজন কুলি-মজুর সবাই আল্লাহর কাছে শ্রমিক, তারা দিনের বেলায় জিবিকার সন্ধানে কাজ করবে এবং রাত্রে বিশ্রাম নিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (১০) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا “আর আমি রাতকে করেছি আবরণ। আর আমি দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।” (সূরা নাবা- ১০-১১)

আল্লাহ আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ “অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।” (সূরা জুমুয়া- ১০)

আল্লাহ তাআলা এখানে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিবিশেষকে উদ্দেশ্য করেননি বরং সকল মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, নামায সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে তোমরা সবাই জমিনে জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করো। শ্রমিকের মর্যাদা বুঝার জন্য এই আয়াতে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আমরা মানুষ হিসেবে সবাই শ্রমিক, সবাই কাজ করি, আবার প্রয়োজনে অন্যকেউ পারিশ্রমিকের বিমিয়ে কাজে লাগাই।

নিজ হাতে উপার্জন করা উত্তম :
মানুষ বসে বসে আহার করবে আর শ্রমিকরা কাজ করবে ইসলাম এমনটি বলেনি বরং সমাজের সবাই কাজ করে জিবিকা নির্বাহ করবে। নিজ হাতে জিবিকা উপার্জন করে পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাবে, এটাই হচ্ছে সর্বোত্তম জিবিকা। মানুষ পরিশ্রমের মাধ্যমে চেষ্টা করলে বা কাজ করলে জিবিকা উপার্জন করতে পারবে, কিন্তু অবসরে বা বসে থাকলে সে কিছুই পাবেনা। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى “মানুষ যতটুকু চেষ্টা করবে, ততটুকু সে পাবে” (সূরা নজম- ৩৯)

রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে বলেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ، وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاودَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ “কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ (আ.) নিজ হাতের কামাই খেতেন।” (সহীহ আল-বুখারী)

শ্রমিককে কাজে লাগানোর পূর্বে তার সাথে চুক্তি করে নেওয়া :
একজন মালিক ও শ্রমিকের দায়িত্ব হচ্ছে যে কোন কাজের পূর্বেই উভয়ের মধ্যে একটা চুক্তি করে নেওয়া। কারণ শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আদায়ের পর। যিনি শ্রম দেন ও যিনি শ্রমিকের পারিশ্রমিক দেন উভয়ের সুসম্পর্ক ও সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। একজন শ্রমিক নিজের উপর অন্যের কাজের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এ কাজ সে সঠিকভাবে সঠিক সময়ের মধ্যে করে দিতে না পারলে তার রিযিক যেমন হালাল হবেনা ঠিক তেমনি পরকালীন সফলতাও পাবেনা। কারণ সে অর্থ উপার্জনের জন্য একাজটি করছে এমনটি না; বরং এর সাথে তার হালাল ভক্ষণ ও পরকালের সফলতা জড়িত বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। এই চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে আল-কুরআনে বলা হয়েছে, وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا “তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।” (বনী ইসরাঈল- ৩৪)

তাই শ্রমিকের দায়িত্ব হচ্ছে চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। আল-কুরআনে বলা হয়েছেন إِنَّ خَيْرَ مَنِ اسْتَأْجَرْتَ الْقَوِيُّ الْأَمِينُ “শ্রমিক হিসাবে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত’ (সূরা আল-ক্বাছাছ- ২৬)

শ্রমিক কত সময় কাজ করবে :
একজন শ্রমিকদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার তার কাজের সময় ও পরিধি নির্ধারণ করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, لاَيُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত কাজের দায়িত্ব দেন না।” (সূরা আল-বাকারা- ২৮৬)
এ আয়াতের আলোকে একজন শ্রমিকের নিকট হতে ততক্ষণ কাজ করে নেয়া যাবে, যতক্ষণ সে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সক্ষম। এর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে মালিক যতক্ষণ ইচ্ছা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। এতে শ্রমিকদের অত্যাচারের সীমা থাকত না। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত শ্রমিকগণ ১৯৮০ সালে মে মাসে শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা কাজ করার দাবীতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। শেষ পর্যন্ত দাবীর মুখে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে তা গৃহীত হয়। কিন্তু ইসলামে কারো দাবী আদায় করার জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন হয়না বরং তার দাবী করার আগেই আল্লাহ তার অধিকার পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।

শ্রমিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য :
রাসূল (সা.) বলেছেন, كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং এ দায়িত্ব সম্পর্কে তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)

রাসূল (সা.) বর্ণিত এ হাদীসের আলোকে শ্রমিক দায়িত্ব গ্রহণের পর কাজে অলসতা প্রদর্শন করলে তার জবাব কিয়াতের দিন তাকে দিতে হবে এবং এর জন্য মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে। আল-কুরআনে শ্রমিক, কুলি-মজুর থেকে শুরু করে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ (১) الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ (২) وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ “তাদের জন্য দুর্ভোগ, যারা ওযনে কম দেয়। ওযন নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে এবং দেওয়ার সময় কম করে দেয়।” (সূরা মুতাফফিফীন- ১-৩)

এ আয়াতের আলোকে শ্রমিকের কর্তব্য হচ্ছে, তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দিবে এবং সুচারুভাবে পালন করবে। এর ফলে সে দ্বীগুন সওয়াবের অধিকারী হবে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলো- وَالْعَبْدُ الَّذِي يُؤَدِّي حَقَّ اللهِ وَيَنْصَحُ لِسَيِّدِهِ. “যে আল্লাহর হক আদায় করে এবং নিজের মালিকের হকও আদায় করে।” (সহীহ আল-বুখারী)

শ্রমিকের পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার :
শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করে দেওয়া ইসলামে ফরজে আইন করা হয়েছে। কারণ শ্রমিকের প্রথম দাবী বা অধিকার হলো তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। হাদীসে কুসসিতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তার মধ্যে একজন হলো- وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ. “যে ব্যক্তি শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে, অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না।” (সহীহ আল-বুখারী)

ইসলাম শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে এই বিধান দিয়ে যে, শ্রমিকের কাজের পারিশ্রমিক তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পরিশোধ করে দিতে হবে। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, أَعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرْقُهُ “শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরী দিয়ে দাও।” (সূনান-ইবনে মাজা)

মালিকের করনীয় :
একজন মালিকের জন্য উচিৎ শ্রমিকের নিকট থেকে ততটুকু কাজ নেওয়া, যতটুকু সে সামর্থ অনুযায়ী অনায়াসে সুষ্ঠুভাবে করতে পারে। এমন কোন কাজ করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না, যার ফলে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে অথবা তার ক্ষতি হয়। আবার এমন কাজও তাকে দেওয়া যাবেনা যেটা করা তার পক্ষে অসম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সাধারণ অর্থনীতিতে একজন শ্রমিককে একটা পাথর সরানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো কিন্তু সে পাথর সরানোর শক্তি তার নেই, কাজেই সে চেষ্টা করেও সেটা সরাতে পারলো না। দিন শেষে মালিক যখন দেখলো সে পাথরটি সরাতে পারিনি তাই তার পারিশ্রমিক দেওয়া হলোনা। কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে এর চিত্র ভিন্ন, সে যদি তার সামর্থ দিয়ে চেষ্টা করে, তাহলে পাথর সরাতে না পরলেও তার পারিশ্রমিক দিতে হবে। কারণ মালিক তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে যেটা আল্লাহ নিষেধ করেছেন।

একজন অসহায় শ্রমিক দেনা রেখে মৃত্যুবরণ করলে তার বিধান :
কোন দিনমজুর বা শ্রমিক যদি মৃত্যু বরন করে এবং তার যদি দায়-দেনা থাকে যা পরিশোধ করার মত কোন ব্যক্তি নেই সেক্ষেত্রে ইসলাম বলছে ইসলামী সরকার বা ইসলামী সমাজ তার সেই দেনা পরিশোধ করবে। রাসূল (সা.) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র পতিষ্ঠা করার পর একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, أَنَا أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ فَمَنْ تُوُفِّيَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فَتَرَكَ دَيْنًا فَعَلَيَّ قَضَاؤُهُ ، وَمَنْ تَرَكَ مَالاً فَلِوَرَثَتِهِ “আমি মুমিনের অভিভাবক। তাদের মধ্যে হতে কেউ মৃত্যুবরণ করলে এবং তার উপর কর্য (দেনা) থাকলে আর তা পরিশোধের যদি কোন ব্যবস্থা না থাকে তবে তা পরিশোধের দায়-দায়িত্ব আমার উপর। আর যদি সে সম্পদ রেখে যায়, তবে তার অংশীদারগণ এ সম্পদের অধিকারী হবে।” (সহীহ আল-বুখারী ও মুসলিম)

পরিশেষে বলা যায়, ইসলামই শ্রমিকের প্রকৃত অধিকার দিয়েছে, মানবতার মুক্তির পথ দেখিয়েছে, সমাজের অসহায়, দরিদ্র, অনাথ-অনাথিনি ও ছিন্নমূল মানুষের মুখে মুক্তির হাসি ফুটিয়েছে। তাই সমাজের সকল স্থরে যদি শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়, তাহলে ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই আসুন সবাই আল-কুরআন ও আল-হাদীস সরাসরি অধ্যয়ন করে ইসলামের আলোকে সমাজ গঠন করার চেষ্টা করি।