বৃষ্টির মৌসুম শুরু হতে না হতেই প্রায় প্রতিদিন ডুবছে ঢাকা। ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের ছবি
১ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৪

সমন্বয়হীনতায় এবারও ডুবছে রাজধানী

গত বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই যখন রাজধানীতে একের পর এক জলাবদ্ধতা হতে শুরু করে, তখন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নগরবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, আগামী বর্ষায় আর জলাবদ্ধতা হবে না। তবে বাস্তবতা হলো, এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার মাস দেড়েক আগেই বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক প্রধান সড়কে পানির ঢেউ খেলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

তিন ঘণ্টায় মাত্র ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতেই রাজপথের অবস্থা এমন হলো কেন, সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল- এবার জলাবদ্ধতার মাত্রা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মেট্রোরেলসহ একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বিভিন্ন এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা এখন বেহাল। অন্যদিকে পানি নিস্কাশনের প্রধান মাধ্যম ড্রেনের দায়দায়িত্ব নিয়ে রশি টানাটানি চলছে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মধ্যে।

এ ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই ঢাকা ওয়াসা বলে আসছে, ড্রেন দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসার ম্যান্ডেটের মধ্যেই ড্রেনের মালিকানা দেওয়া আছে। ওয়াসা বার বার অনুরোধ করছে ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে দিতে। অন্যদিকে ড্রেনেজ নামের এই 'পঙ্গু' সন্তানের দায়দায়িত্ব নিতে অনীহা সিটি করপোরেশনের। এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা। যা এবার আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ওয়াসা ড্রেন-বক্সকালভার্ট পরিস্কারের উদ্যোগ না নিয়ে এমনকি বর্ষা মৌসুম দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলেও হাত গুটিয়ে বসে আছে। অথচ বর্ষা মৌসুমের অন্তত ছয় মাস আগে এটা শুরু করতে হয়।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত গবেষণায় যুক্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন 'সিপ'-এর দুর্যোগ সহনশীল ঢাকা কর্মসূচি প্রকল্পের সমন্বয়ক সাইফুন নাহার সমকালকে বলেন, জলাবদ্ধতার মতো বড় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসার যেভাবে যৌথভাবে প্রকল্প নেওয়া দরকার, তেমনটি এখনও হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলেই ভোগান্তিতে পড়ছে নগরবাসী।

নেপথ্য কারণ : ওয়াসার অভিযোগ, সিটি করপোরেশন সারফেস (উন্মুক্ত) ড্রেনগুলো পরিস্কার রাখে না। আবার সিটি করপোরেশন জানাচ্ছে, ওয়াসা বক্সকালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ পরিস্কার করে না। পরিস্কারের নামে প্রকৌশলী ও ঠিকাদার টাকা-পয়সা লুটে নেন। পাল্টাপাল্টি এই অভিযোগের একপর্যায়ে গত বর্ষা মৌসুমে ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন ওয়াসাকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান তখন ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেন। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, 'কোনো পঙ্গু সন্তানকে ভালো করার দায়িত্ব তিনি নেবেন না।'

এ অবস্থায় গত ১ জুলাই মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারফ হোসেন দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাসরিন আক্তারকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার আইন পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রণয়ন করা। সেই কমিটি দীর্ঘদিনেও কোনো সুপারিশ জমা দিতে পারেনি। এদিকে ওয়াসা স্টর্ম স্যুয়ারেজ ও বক্সকালভার্ট পরিস্কার থেকে বিরত রয়েছে।

আইনেও জটিলতা : ১৯৯৬ সালের পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসা পানি নিস্কাশনের জন্য বড় ড্রেন নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও খাল দেখভাল করবে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর তৃতীয় তফসিলে বলা হয়েছে, ছোটখাটো নালা, ড্রেন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে সিটি করপোরেশন। এই আইনের সূত্র ধরে সংস্থা দুটি পরস্পরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। এদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের ওই কমিটিও এখনও কোনো সুপারিশ দিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে কমিটির আহ্বায়ক নাসরিন আক্তার জানান, সুপারিশগুলো তৈরি করা হয়েছে। তবে কমিটির সদস্যদের একসঙ্গে পাওয়া কঠিন হওয়ায় একটু দেরি হয়েছে।

এদিকে এবার ওয়াসার শীর্ষ পর্যায় থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, ওয়াসা এবার কোনো বক্সকালভার্ট ও ড্রেন পরিস্কার করবে না। খাল খনন ও বর্জ্য অপসারণের কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তারা। এমনকি এসব কাজের জন্য কোনো অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। প্রতি বছর অক্টোবর মাস থেকেই ওয়াসার বক্সকালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ পরিস্কারের ফাইলপত্র প্রক্রিয়াকরণের কাজ শুরু হলেও চলতি দফায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি গত বছর আগারগাঁও এলাকায় সাড়ে তিন কি. মি. পানি নিষ্কাশন নালা নির্মাণের পর নতুন নালা নির্মাণেরও কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। পানি নিস্কাশনের জন্য ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের যে শ'দেড়েক জনবল রয়েছে, তারাও কাজকর্ম ছাড়াই বেতন নিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকল্প পরিচালক নূরুল ইসলাম সমকালের সঙ্গে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এ নিয়ে যা বলার জনসংযোগ বিভাগ বা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দপ্তর থেকেই বলা হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ড্রেনেজ সার্কেল সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত হওয়ার কথা ছিল। সেটা না হওয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করছেন। রাজধানীতে কোনো জলাবদ্ধতা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, যেটা হয় সেটা জলজট এবং কিছু সময় পরই পানি নেমে যায়। এবার সেই জলজটও অনেক কম হবে।

রাজধানীতে প্রায় ১০ কিলোমিটার বক্সকালভার্ট রয়েছে। এই বক্সকালভার্ট বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের অন্যতম মাধ্যম। এ ছাড়া রয়েছে ৩৫০ কি. মি. স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইন। এ দুটি মাধ্যমেই বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জলাশয়, খাল বা নদীতে পড়ে। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের রয়েছে দুই হাজার ৫১ কি. মি. সারফেস ড্রেন। মূলত বৃষ্টির পানি সারফেস ড্রেন দিয়ে বক্সকালভার্ট বা স্টর্ম স্যুয়ারেজ লাইনে প্রবেশ করে। এই পানি নিচু জলাশয়ে গিয়ে জমা হয়।

ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শেষে বক্সকালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজের অন্তত ৮০ শতাংশই ভরাট হয়ে যায়। সেগুলো পরিস্কারের জন্য প্রতি বছর অক্টোবর মাস থেকে দরপত্র আহ্বান, দরপত্র যাচাই-বাছাই, যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচন ও কার্যাদেশ প্রদানের কাজ শুরু হয়। এসবের প্রতিটি ধাপে প্রায় এক মাস করে সময় ব্যয় হয়। কার্যাদেশ দিতে দিতে মাঝে মধ্যে ফেব্রুয়ারি-মার্চও হয়ে যায়। এবার ঠিক সময়ে এসব কাজ শুরু হয়নি। তা ছাড়া রয়েছে সমন্বয়হীনতা। সব মিলিয়ে মন্ত্রী এবং মেয়রের আশ্বাস এবারও গুড়েবালিতে পরিণত হতে পারে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, সারফেস ড্রেনগুলো পরিস্কারের ব্যাপারে দুই সিটি করপোরেশন কাজ করছে। কিন্তু ওয়াসা যদি বক্সকালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ পরিস্কার করার উদ্যোগ না নেয়, তা হলে সারফেস ড্রেন পরিস্কার করে কোনো লাভ হবে না। এ কথা জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান। সমকালকে তিনি বলেন, সারফেস ড্রেনের পানি বক্স কালভার্ট ও স্টর্ম স্যুয়ারেজ দিয়েই যায়। সেগুলো পরিস্কার না হলে বৃষ্টির পানি রাস্তার ওপরেই ভাসবে। তবে সিটি করপোরেশন সারফেস ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিস্কার করে থাকে। এবারও করছে।

ভোগান্তির শেষ নেই : জলাবদ্ধতা আর বৃষ্টির ভোগান্তি থেকে গতকালও মুক্তি পাননি নগরবাসী। আগের দিনের জলাবদ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল রাজধানীতে আবারও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে নগরবাসীকে পড়তে হয় মহাবিড়ম্বনায়। প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ের কারণে অনেক স্থানে গাছ ভেঙে পড়ে। রাজপথে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। অনেক স্থানে কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যায় রাজপথ। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়।

আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজধানীতে ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ১২ ঘণ্টার ৩২ মিলিমিটারের এই বৃষ্টিপাতে অলিগলি কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যায়। কাঁচাবাজারগুলোতে উৎকট পরিবেশ বিরাজ করে। আবহাওয়া অফিস জানায়, আজও রাজধানীতে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিপাত হতে পারে।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে বিজয়নগরে কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়ে। একটি গাছ রাস্তার মাঝামাঝি পড়ায় যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। আশপাশে যানজট লেগে যায়। এ ছাড়া হেয়ার রোড, মানিক মিয়া এভিনিউ, চন্দ্রিমা উদ্যান, রোকেয়া সরণিতেও বেশ কয়েকটি গাছ ভেঙে পড়ে। মালিবাগ, আরামবাগ, নাজিমুদ্দিন রোড, মিরপুর ১০ নম্বর ও আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা বিভিন্ন স্থানে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়।

http://samakal.com/capital/article/18057