১ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৮

বিনিয়োগের চেয়ে ঋণেই বেশি আগ্রহ বিদেশীদের

সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে সরকার বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। টেক্সটাইল, চামড়াজাত সামগ্রী, ইলেকট্রনিকস দ্রব্য, রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিভিত্তিক শিল্প, কাঁচা পাট, কাগজ, রেশম শিল্প, হিমায়িত খাদ্য, পর্যটন, কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প, সফটওয়্যার ও ডাটা প্রসেসিংয়ের মতো রফতানিমুখী শিল্পে বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করাতে চলছে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ বিদেশীরা এ দেশে বিনিয়োগ করার চেয়ে ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ২০১৭ সালে দেশে যে পরিমাণ প্রকৃত এফডিআই এসেছে, তা আগের বছরের চেয়ে ৮ শতাংশ কম। অন্য দিকে গত বছর বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ ২৪ শতাংশ বেড়েছে। গত কয়েক বছরে বিদেশী বাণিজ্যিক ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। অন্য দিকে বিদেশী বিনিয়োগ দিন দিন কমছে। অভিযোগ উঠেছে, ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ঋণ এনে এমন সব কাজে ব্যবহার করছেন, যা অনুমোদনযোগ্য নয়। ফলে আগামী দুই থেকে তিন বছরে অর্থনীতিতে এর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে নিট বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ২১৫ কোটি ডলার। ২০১৬ সালে ছিল ২৩৩ কোটি ডলার। মোট বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৭ সালে ২৬৮ কোটি ডলার। আগের বছর যা ছিল ২৮৩ কোটি ডলার। আশঙ্কার বিষয়, ২০১৭ সালে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পুঁজি প্রত্যাহার, মূল কোম্পানির কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে ৫৩ কোটি ডলার বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে গেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগ উদ্বেগজনক হারে কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

বিদেশী বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসিআইর সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিম্নমাত্রার। এর বৃদ্ধি বা কমে যাওয়া বড় ইস্যু নয়। এখানে বড় প্রবৃদ্ধি দরকার। বাংলাদেশে নিট বিদেশী বিনিয়োগ ২ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটি অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার হওয়া উচিত। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে বিদেশী বিনিয়োগে বড় বাধা অবকাঠামোর ঘাটতি। এর সাথে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরেকটি কারণ। তিনি বলেন, সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এগুলো দৃশ্যমান হতে আরো সময় লাগবে।

এ দিকে বিদেশী বিনিয়োগের বিপরীত চিত্র বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) তথ্যানুযায়ী, বেসরকারি খাতে ২০১৩ সালে বিদেশী ঋণ ছিল ৪০০ কোটি ডলার। ২০১৭ সাল শেষে তা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ১০০ কোটি ডলার। গত বছর বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এ খাতে ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি এসব ঋণের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পুরো অর্থনীতিতে যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে ১১ ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে জানিয়ে বিআইবিএমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এর অন্যতম হলো বৈদেশিক মুদ্রা ঝুঁকি। এ ছাড়া ঋণের খরচ, বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে দেশে ব্যবহারের উপযোগিতা, নৈতিক ঝুঁকি, ঋণের সঠিক ব্যবহার, নীতি সহায়তা, আবেদনের যথার্থতা যাচাই, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ঋণ ও দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশী ঋণের মধ্যে বর্তমানে ২৪ শতাংশ রয়েছে পোশাক খাতে। পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতে ২১ শতাংশ, সোয়েটারে ১৬ শতাংশ, ডায়িং ও নিট গার্মেন্টে ১২ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১১ শতাংশ, প্লাস্টিকে ৫ শতাংশ, সেবায় ৩ শতাংশ ও ওষুধে রয়েছে ২ শতাংশ।

তথ্যানুযায়ী ২০০৯ সালের দিকে ব্যাংকে উচ্চ সুদের কারণে একটি সঙ্কট সৃষ্টি হয়। রফতানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তখন বিদেশী ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। তবে শর্ত ছিল ঋণগ্রহীতারা যেন সঠিক খাতে ব্যবহার করে তা নিশ্চিত করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশী ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ তাদের স্থানীয় ঋণ পরিশোধ করেছেন। বিদেশী ঋণ বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে এর অপব্যবহারও। ব্যাংকিং খাতে এটি নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশী ঋণের অপব্যবহার ঠেকাতে না পারলে পুরো অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে।

তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে বস্ত্র খাতে, যার পরিমাণ ৪২ কোটি ডলার। এরপর রয়েছে ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাসসহ অন্যান্য খাত। এ বছর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে, ৩১ কোটি ডলার। শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে আরো রয়েছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, নরওয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সাল ধরে এ পর্যন্ত মোট এফডিআই স্থিতি এক হাজার ৪৫৬ কোটি ডলার। ২০১৬ সাল শেষে স্থিতি ছিল এক হাজার ৪৫৪ কোটি ডলার। এফডিআই স্থিতি বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এর পরিমাণ ৩৩৩ কোটি ডলার।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/314852