১ মে ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৫৪

আস্থার সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত

অন্যায়ের ফল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে

কেলেঙ্কারির পর জনগণের আমানত ফেরত দিতে পারছে না নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে নতুন ব্যাংকসহ সমগ্র ব্যাংকিং খাতের ওপর। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে আস্থার সঙ্কটে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এ পরিস্থিতিতে পুরনো ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেকায়দায় পড়ে গেছে অন্য নতুন ব্যাংকগুলো। সাধারণ আমানতকারীরা আমানত রাখতে চাচ্ছেন না নতুন ব্যাংকগুলোতে। আবার ফারমার্স ব্যাংকের বড় অঙ্কের সরকারি আমানত আটকে পড়ার পর অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন ব্যাংক থেকে টাকা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সব মিলে পুরনো ব্যাংকগুলোর সাথে সাথে নতুন ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের হার কমে যাওয়ায় অর্থসঙ্কটে পড়েছে এসব ব্যাংক।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গত রোববার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে সার্বিক দিক থেকে বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। অপর দিকে বেড়ে যাচ্ছে অপরিশোধিত ঋণ অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ফলে ব্যাংকগুলো মুনাফা করার জন্য আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। ঋণপ্রবাহ বাড়াতে দেদার ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার করা হচ্ছে না। অর্থাৎ গ্রাহকের ঋণপরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনা না করেই ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কয়েক মাস ধরেই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে। এই ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে ঋণের সুদহারও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু যে হারে ঋণের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে সেই হারে আমানতের সুদহার বাড়ানো হচ্ছে না। ফলে ঋণ আমানতের সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) বেড়ে যাচ্ছে। এসবই ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধূরী গত রোববার নয়া দিগন্তকে বলেন, কোনো ব্যাংকের যখন কোনো সঙ্কট দেখা দেয় তখন স্বাভাবিকভাবে অন্য ব্যাংকগুলোর ওপর তো কম বেশি প্রভাব পড়বেই। ফারমার্স ব্যাংকের কেলেঙ্কারির পর ওই ব্যাংকের আমানতকারীরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। স্বাভাবিকভাবে এর প্রভাব অন্য ব্যাংকগুলোর ওপর পড়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলোÑ ব্যাংকগুলোর পাপের ফসল জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফারমার্স ব্যাংক যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সে জন্য ব্যাংকটিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার তহবিল জোগান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অর্থ জনগণের অর্থ। অন্যের পাপ চাপানো হচ্ছে জনগণের ঘাড়ে। তিনি বলেন, আমাদের বক্তব্য হলো উন্নত বিশ্বে প্রায়ই ব্যাংক বন্ধ হয়। আবার নতুন ব্যাংক চালু হয়। তেমনিভাবে আমাদের দেশের ব্যাংকের পাপের ফসল জনগণের ওপর না চাপিয়ে লাইসেন্স বাতিল করার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। কেননা, আমাদের খারাপ দিক হলোÑ এ দেশে ব্যাংক খোলার ব্যবস্থা আছে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ এ ধরনের কোনো আইন নেই। আমরা চাচ্ছি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হোক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, লাইসেন্স পাওয়ার পরপরই নতুন ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে নামে। বাছবিচার না করেই ঋণ বিতরণ করে। এসব ঋণ ফেরত না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশলগত চাপ দিয়ে কেউ কেউ রাতারাতি ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। যেমন একটি তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক ১২ বছরে ৬৫টি শাখা খুলেছে। আর সেখানে চতুর্থ প্রজন্মের একটি নতুন ব্যাংক মাত্র চার বছরে ৬০টি শাখা খুলেছে। এটা নিঃসন্দেহে আগ্রাসী ব্যাংকিং। ঋণ ভাগাভাগি করে নিয়ে যাচ্ছেন কোনো কোনো ব্যাংকের পরিচালকেরা। নিজের ব্যাংকের পাশাপাশি নিচ্ছেন অন্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিচ্ছেন। আবার বেনামেও ঋণ নিচ্ছেন কেউ কেউ। বর্তমানে এ ধরনের বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে মেঘনা ব্যাংকের ৯৩ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকাই কুঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হয়েছে। মিডল্যান্ড ব্যাংকের ৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৩৭ কোটি টাকাই মন্দ ঋণ। এনআরবি ব্যাংকের ৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪২ কোটি টাকা মন্দঋণ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রায় ৭৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৫৯ কোটি টাকাই মন্দঋণ। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের মধ্যে ৬১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩২ কোটি টাকা মন্দঋণ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ৫৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪২ কোটি টাকাই মন্দঋণ। দি ফারমার্স ব্যাংকের ৭২৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকাই মন্দঋণ।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণের প্রায় পুরোটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, জোরজবরদস্তি করে কিছু টাকা আদায় করা হচ্ছে কারো কারো কাছ থেকে। তবে এটা স্থায়ী সমাধান নয় বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

বিআইবিমের এক এক গবেষা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক তার নিট মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থ সিএসআরে (সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কাজ) ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ২০১৬ সালে নতুন প্রজন্মের এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করেছে, যা খুবই অস্বাভাবিক। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক ৯৯ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৯২ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ৩৫ শতাংশ ব্যয় করেছে। ২০১৪ সালে এনবিআরবি গ্লোবাল ৪৯ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩৭ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংক ১৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।

আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে ব্যাংকগুলোতে এখন অনেকটা টানাটানির মধ্যে পড়ে গেছে। বিশেষ করে ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর নতুন ব্যাংকগুলোর সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তার ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। আমানতের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে প্রত্যাহার হয়ে গেছে। সরকারি কিছু আমানত ছাড়া নতুন আমানত বলতে গেলে আসছেই না। কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমানত আনতে গেলে ফারমার্স ব্যাংক উদাহারণ হিসেবে টেনে আনছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি এখন তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিয়ে আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/314816