৩০ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৮:১২

লা-নিনো ও এমজেও’র প্রভাবে অসময়ে ভারি বৃষ্টি

জলজটে রাজধানীতে সীমাহীন দুর্ভোগ

মৌসুমের রেকর্ড ৬৮ মিমি. বৃষ্টিপাত * এ পরিস্থিতি থাকবে আরও কয়েকদিন

বৈশাখেই যেন এসে গেছে আষাঢ়। রোববার দিনের বেশিরভাগ সময় ধরে দেশের অধিকাংশ স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। অসময়ের এমন বৃষ্টিতে মহাদুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক জলজট তৈরি হয়। ঢাকার অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলজট সৃষ্টি হয়। সারা দেশে ঝড়-বৃষ্টির এ প্রবণতা আরও কয়েকদিন চলতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফদর (বিএমডি)।

সকাল ৮টার দিকে ঢাকায় ৭৩ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়াসহ কালবৈশাখী আঘাত হানে। এরপর শুরু হয় ৩ ঘণ্টার মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় ঢাকায় ৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত ময়মনসিংহে ৭২ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। এটি চলতি মৌসুমে ১ দিনের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ বছরে কয়েকদিন ধরে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণত বৈশাখে এমন বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা নয়। বর্তমানে দুটি সিস্টেমের প্রভাব আবহাওয়া ও বায়ুমণ্ডলে বিস্তার লাভ করেছে। অক্টোবর-নভেম্বর থেকে লা-নিনো চলছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি এমজেও (ম্যাডেন জুলিয়ান ওসিলেশন) যুক্ত হয়েছে। লা-নিনো হল- প্রশান্ত মহাসাগরের বিশেষ স্থানের পানির তাপমাত্রার বিশেষ পরিস্থিতি। যদি পানির তাপমাত্রা দশমিক ৫০ ডিগ্রি কম-বেশি হয় তখন লা-নিনো এবং এল-নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। বর্তমানে চলমান লা-নিনোর কারণে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। ২০০৭ সালের বন্যায় লা-নিনো পরিস্থিতি ছিল। আর এমজেও হল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলে পরিবর্তনশীলতার বিশেষ উপাদান। এটি যখন যে অঞ্চলে থাকে তখন সেখানে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির সৃষ্টি করে। ২২-২৩ এপ্রিল থেকে এমজেও ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অবস্থান করছে। উল্লিখিত দুই প্রভাবে এবার বাংলাদেশে বৈশাখে বেশি ঝড় ও বৃষ্টি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, অলিগলি কয়েক ঘণ্টার বর্ষণে তলিয়ে যায়। এতে করে ছুটির দিনেও তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সকাল ৮টার দিকে রাজধানীতে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী। আবহাওয়া অফিস বলছে, ঝড়ের সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭৩ কিলোমিটার। ভারি বর্ষণে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বর, ১৩ নম্বর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে, ১৪ নম্বর সেকশন, শেওড়াপাড়া, ইব্রাহিমপুর, কচুক্ষেত এলাকার বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে ১০ নম্বর থেকে ফার্মগেটমুখী সড়কে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক গাড়িকে মিরপুর-১ নম্বর ঘুরে ফার্মগেটের দিকে যেতে দেখা যায়। পশ্চিম রাজাবাজার, ইন্দিরা রোডে ময়লা পানিতে রাস্তা সয়লাব হয়ে যায়। ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা এমএ করিম যুগান্তরকে বলেন, এ বৃষ্টিতে প্রধান সড়কসহ আশপাশের অলিগলিতেও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। উন্নয়ন কাজের জন্য সড়কে বড় বড় গর্ত করে রাখা হয়েছে। এ কারণে এ এলাকার সড়কে বড় ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। মোহাম্মদপুরের বসিলা সড়কের বিশাল অংশ হাঁটুপানিতে তলিয়ে যায়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার পূর্বপাশের রাস্তা, চন্দ্রিমা উদ্যানের মুখ এবং জাহাঙ্গীর গেট এলাকার সড়কের এক প্রান্তেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, আরামবাগ, পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, নাজিমউদ্দিন রোড পানির নিচে তলিয়ে ছিল। জলাবদ্ধতার পাশাপাশি বেশিরভাগ সড়কে উন্নয়ন কাজ চলায় হাঁটুপানির নিচে তলিয়ে থাকা সড়কে চলাচল করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, সকালের বৃষ্টির পর ঘর থেকে বের হয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। কাছাকাছি কোনো গণপরিবহন না পেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায় রিকশায় চলতে হয়েছে। জলাবদ্ধতা, সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে চলাচলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। পুরান ঢাকার বকশিবাজার এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বৃষ্টি হলেই পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, নাজিমউদ্দিন রোডসহ আশপাশের এলাকার সড়কগুলোয় হাঁটুপানি জমে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাশাপাশি এ এলাকার সড়কে উন্নয়ন কাজের কারণে ভোগান্তির মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দনিয়ার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বাবু বলেন, ৩০ বছর ধরে তিনি এ এলাকায় বসবাস করছেন। বর্ষা মৌসুম এলে তার দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। পুরো মৌসুমে জলাবদ্ধ সড়ক মাড়িয়ে চলাচল করতে হয়। এ ভোগান্তির শেষ কবে, তা জানেন না কেউ?

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খোন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ভারি বর্ষণে ডিএসসিসির ধানমণ্ডি, গ্রিনরোড, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, আলাউদ্দিন রোড, আরামবাগ, মতিঝিল, জুরাইন, দনিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় পানি জমে যায়। সকাল থেকে সেসব এলাকার ড্রেনেজ পরিষ্কার করে পানির স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে করে বিকালের মধ্যেই বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশন হয়ে যায়। তিনি বলেন, ডিএসসিসি এলাকার ড্রেনগুলো সচল রয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখা হচ্ছে। তারপরও ভারি বৃষ্টি হলে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়। এ কারণে তাৎক্ষণিক কার্যক্রমও পরিচালনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, রোববারের ভারি বৃষ্টির কারণে ডিএনসিসির বেশ কিছু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে যায়। এতে করে যান চলাচলসহ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সকাল থেকে পানি নিষ্কাশন স্বাভাবিক রাখতে ডিএনসিসির কর্মীরা তৎপর ছিলেন। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, রোববারের ভারি বৃষ্টির কারণে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়। সেসব পানি নিষ্কাশন করতে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার কর্মীরাও তৎপর ছিলেন। অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলে পানি সরতে একটু সময় লাগে। পানি দ্রুত সরাতে সকাল থেকে তৎপরতা চালানো হয়েছে।

তুরাগ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, রোববারের বৃষ্টির কারণে এলাকায় বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন মানুষজন। বিশেষ করে তুরাগের হরিরামপুর ইউনিয়নের ছোট-বড় ৩৩টি গ্রামের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েন। খানাখন্দে ভরা বেশিরভাগ রাস্তা ডুবে থাকায় পথে পথে বিকল হচ্ছে পরিবহন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/43751