সড়ক দূঘর্টনায় অকালে ঝড়ে যাওয়া তাজা প্রাণ রোজিনা ও রাজিব
৩০ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৮:০৮

রোজিনাকেও বাঁচানো গেল না

এভাবে আর কত প্রাণ ঝরবে

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হচ্ছে ১৫০ জন * মৃত্যু শঙ্কায় পা হারানো রাসেল

বাসচাপায় ডান পা হারানো রোজিনাকেও (২১) বাঁচানো গেল না। ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান তিনি। ভাগ্যতাড়িত রোজিনা গৃহকর্মীর কাজ করতে রাজধানীতে এসেছিলেন।

কিন্তু এই রাজধানী তাকে আপন করে নিতে পারেনি। তার মৃত্যুতে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার নিজ গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ৬ বোন আর ১ ভাইয়ের মধ্যে রোজিনা দ্বিতীয়। গৃহপরিচারিকার কাজ করে বাবার অভাবের সংসার চালাতেন। নিজেও চলতেন।
কিন্তু ঘাতক বাসচালক তার সব স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রাণটাও কেড়ে নিল। গত ২০ এপ্রিল রাতে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় উত্তরাগামী বিআরটিসি দোতলা বাসের চাপায় রোজিনার ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এরপর রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। গত ১৬ এপ্রিল এই হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় করুণ মৃত্যু হয় রাজীব হোসেন নামে তিতুমীর কলেজের এক ছাত্রের। ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় দুই বাসচালকের রেষারেষিতে ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয় তার।

রাজীবের মৃত্যুর পরদিন ১৭ এপ্রিল গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় হৃতয় নামে ৩০ বছর বয়সী এক বাসযাত্রীর হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওভারটেক করার সময় ট্রাকের ঘষায় তার হাত বিচ্ছিন্ন হয়।
২৮ এপ্রিল রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাঁ-পা হারান রাসেল সরকার (২৩) নামে এক যুবক। এভাবেই সড়কে একের পর এক প্রাণ ঝরছে। অনেকে চিরতবে পঙ্গুত্ববরণ করছেন।

রোববার সকাল ৬টা ৫৫ মিনিটে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যু হয় রোজিনার। রোজিনার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ঘোনাপাড়া গ্রামে। মেয়ের মৃত্যুতে হতদরিদ্র বাবা রসুল মিয়া ও মা রাবেয়া বেগম ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করছিলেন।
রাবেয়া বেগম মেয়ের লাশ জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে বলছিলেন, ‘মাগো, তুই কেন আমরারে ফালাইয়া চইল্লা গেলি। তরে হেরা (বাসচালক) মাইরা লাইছে। বাসের বেডা (বাসচালক) তর জীবন ছিঁড়া নিছে। আমরা কেমনে বাছুম। তুই কতা (কথা) ক (বল), কতা ক...।’
পাশেই অসুস্থ বাবা রসুল মিয়া বুক চাপড়িয়ে কাঁদছিলেন। অসহায় এ মা-বাবার কান্নার দৃশ্য যারা দেখেছেন তারাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। রসুল মিয়া হৃতরোগী আর মা রাবেয়া বেগম জরায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত বেশ কয়েক বছর ধরে। অর্থাভাবে তারা সুচিকিৎসা করাতে পারছেন না।

অসুস্থ বাবা রসুল মিয়া বলছিলেন, ‘মেয়ের লাশ নিয়ে গ্রামে কবর দেব। আর কোনো সন্তানকে মরে গেলেও রাজধানীতে পাঠাব না। এখানে (রাজধানীর) থাকা মানুষের মধ্যে মায়া-মমতা নেই। অনেক চালকই অমানুষ।’
মেয়ের খুনিদের শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, ‘এ মেয়েই ছিল আমার পরিবারের কর্তা। মেয়ের টাকায় সংসার চলত। টাকার অভাবে স্ত্রী ও নিজের চিকিৎসা করাতে পারছি না।’
বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, রোজিনাকে বার্ন ইউনিটে আনার পরপরই ৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রদান করা হয়। মূলত রোজিনার ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হয়ে যায় এবং সেই ইনফেকশন থেকে তা ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার শিকার লোকজন সাধারণত শঙ্কায় থাকেন। কারণ, যান দুর্ঘটনার শিকার লোকজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মাথায় ও বুকে রক্তক্ষরণ হয়। প্রচণ্ড ট্রমায় ভোগেন। ফলে তাদের বাঁচানো খুব কষ্ট হয়।’
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমি মনে করি, এসব মৃত্যু কখনোই স্বাভাবিক মৃত্যু না। এগুলো হত্যা। খুব কষ্ট হয়, যখন দেখি চোখের সামনে এমন তরতাজা প্রাণগুলো ঝরে যাচ্ছে। শনিবার রাসেল নামের আরেকটা ছেলে পা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ভর্তি হয়েছে, সেও বাসের নিচে পড়ে। এর আগে রাজীব মারা গেল। আমি এখন এসব মৃত্যু দেখে কাঁদি। রোজিনার মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। তার মা-বাবা কত যে দরিদ্র তা আমি কাছ থেকে দেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘হিংস্র ঘাতকদের রুখতে হবে এখনই। সম্মিলিতভাবে এমন অরাজকতা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে না। ওই মিছিলে আমাদের সন্তানদেরও নাম আসবে।’
রোজিনা আমার সন্তান ছিল : বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা জানান, রোজিনা আক্তার তার বাসায় থাকতেন। রোজিনা ছিল তার পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। রোজিনা কাজের মানুষ হিসেবে থাকতেন না। রোজিনা তার সন্তান ছিল, সন্তানের মতোই তাকে দেখতেন। রোজিনা আক্তার নেই... বলেই সাংবাদিক রেজা শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করেন।
এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে চালক নামের ঘাতকদের রুখতে না পারলে এমন মৃত্যুর মুখোমুখি যে কেউ হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই এমন বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো হয় না।
দেশে পরিবহন মালিক আর শ্রমিক মিলে একটি ভয়ংকর চক্রের সৃষ্টি হয়েছে। এ চক্র কাউকেই মানে না। কারণ এ চক্রের মাথার ওপর আশীর্বাদ রয়েছে। আশীর্বাদের কারণে তারা কাউকে পাত্তা দেয় না। মানুষ খুন করে তারা উল্লাস করে।’

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয় ১৫০ জন : বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে বাসচালকরা দানব হয়ে উঠছে। মানুষ মারা তাদের কাছে কোনো বিষয়ই মনে হচ্ছে না।
পাশাপাশি অনেক যাত্রী ও পথচারী ট্রাফিক আইন মানছেন না। তিনি বলেন, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে ১৫০ জনের বেশি মানুষ। চলতি বছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৮৪১ জন। আর আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৪৭৭ জন। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ২৮৮ জন।

তিনি বলেন, সড়কে এখন নৈরাজ্য চলছে। এ নৈরাজ্য থামাবে কে? বিদ্যমান আইনের কোনো বাস্তবায়ন হয় না। চালক নামের ঘাতকদের রোধ ও পরিবহন ব্যবস্থার নৈরাজ্য ঠেকাতে না পারলে আমরা কেউই নিরাপদ থাকব না। ঘাতকরা যে কোনো সময় চাপা দিয়ে প্রাণটা কেড়ে নেবে।
এলাকায় শোকের ছায়া : ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, রোববার সন্ধ্যায় রোজিনার লাশ গ্রামের বাড়ি ধোবাউড়ার ঘোনাপাড়া গ্রামে পৌঁছে। এ সময় এলাকার মানুষ লাশ দেখতে ভিড় জমান। অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর এশার নামাজের পর লাশ বাড়ির পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/43742