২৯ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১২:০১

মোটর পার্টসের ৫ হাজার কোটি টাকার বাজার বিদেশীদের দখলে

দেশের অভ্যন্তরে ভারী শিল্প হিসেবে খ্যাত দেশীয় গাড়ি তৈরি ও বাজারজাত করায় উৎসাহ প্রদান করছে না বলে অভিযোগ এ খাত-সংশ্লিষ্টদের। শুল্ককর আর স্থানীয় গাড়ি উৎপাদনে মূসকের কারণে এ খাতের বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিআরটিএর হিসাবে সারা দেশে গত নবেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ২৮ লাখ ৪২ হাজার ৩১৯টি গাড়ি। এসব গাড়ি মেরামতে দেশে কোনো যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে না। ফলে গাড়ি মেরামতে দেশের মোটর পার্টস বাজারের আকার ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ বাজার আরো বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু এসব পার্টসের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।

উদ্যোক্তাদের দাবি রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশন, মোটরসাইকেলের মতো বিনিয়োগঘন ভারী শিল্প স্থাপনে শুল্ককর সুবিধা দেওয়ার ফলে এসব খাত বর্তমানে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশীয় গাড়ি উৎপাদন শিল্পকে এভাবে মূসক ও শুল্ককর সুবিধা দেওয়া হলে এ খাত অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখতে পারবে। দেশে প্রথমবারের মতো গাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করেছে পিএইচপি গ্রুপ। স্থানীয় গাড়ি উৎপাদনে ভ্যাট ও শুল্ককর প্রত্যাহারে এনবিআর চেয়ারম্যানকে সম্প্রতি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সই করা চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরে ভারী শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা হিসেবে শুল্ককর ছাড় দিচ্ছে সরকার। ফলে দেশে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশন ও মোটরসাইকেলের মতো ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ খাতে আমদানি-নির্ভরতা কমে গেছে। সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানি এসব পণ্য রফতানি শুরু করেছে। ‘জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬’-তে অটোমোবাইল শিল্পকে অগ্রাধিকারভিত্তিক শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হলেও এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে কোনো প্রণোদনা বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা-নীতিমালা এখনও প্রণয়ন করা হয়নি।

মোটর পার্টসের আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাজারে গাড়ির যেসব পার্টস বিক্রি হচ্ছে তার প্রায় শতভাগই আমদানিকৃত। এসব পার্টস মূলত চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান ও তাইওয়ান থেকে আমদানি করা হয়। বাস, ট্রাক, লরি, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, হিউম্যান হলার, ইজিবাইক, রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেলসহ বিভিন্ন গাড়ির টায়ার, টিউব, ব্রেক সু, ইঞ্জিন অয়েল, ব্যাটারি থেকে শুরু করে যাবতীয় পার্টসই আমদানিনির্ভর। আমদানিকৃত এসব পার্টসের দাম ও মান যাচাইয়ের কোনো সুযোগ দেশে নেই। ফলে মানুষ মানহীন পার্টস কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। অন্যদিকে স্বল্পমূল্যে আমদানিকৃত পণ্য চড়া দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

পুরান ঢাকার ধোলাইখালের পার্ট ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া মোটর পার্টসের আসল-নকল নিরূপণ করার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট কারো নেই। চীন, তাইওয়ান ও ভারত থেকে এমন সব পার্টস তৈরি হয়ে আসছে, যা দেখে কারো পক্ষেই আসল-নকল শনাক্ত করা সম্ভব নয়। এ কারণে ভোক্তাদের পাশাপাশি নিয়মিত ক্রেতা হারানোর ভয়ে বিড়ম্বনায় রয়েছেন বিক্রেতারাও। গাড়ি মেরামতের সময় যন্ত্রাংশের মূল্যসহ কোটেশন দাখিল করতে হয়। কিন্তু একই পার্টস একেক স্থানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে তারা বিভ্রান্তিতে পড়ছেন। নিজেদের ইচ্ছা মত একই পার্টস কেউ বিক্রি করছে জাপানী হিসেবে কেউ আবার চায়না হিসেবে। নিজেদের ইচ্ছা মতই দাম নির্ধারণ করছে তারা।

জানা গেছে, যন্ত্রাংশ তৈরিতে রয়েছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। এটি পরিচালনা করে থাকেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুযারি এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকে এটি সব ধরনের গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করলেও বর্তমানে শুধু সেনাবাহিনীর বিশেষ সামরিক যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়ে থাকে।
যার কারণে দেশের প্রাইভেট এবং পাবলিক সব ধরনের গাড়ির যন্ত্রাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ মোটর পার্টস ও টায়ার-টিউব ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি মাহবুবুর রহমান বলেন, দেশে মোটর পার্টসের ব্যবসা ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে এ খাতের বাজার ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এসব যন্ত্রাংশ মূলত ভারত ও চীন থেকে আসে। গাড়ির পার্টসগুলো আসল হলে গাড়িটি দীর্ঘদিন সচল থাকে। পাশাপাশি এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কম থাকে। সবদিক বিবেচনায় এসব মোটর পার্টসের গুণমান দেখভালের বিষয়টিতে সরকারের নজর দেয়া উচিত।

বংশালের একাধিক মোটর পার্টস ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হওয়া মোটরসাইকেল পার্টসগুলোর অধিকাংশই আসে যশোর থেকে। এর অধিকাংশই দেশে ঢুকছে শুল্ক ও কর ফাঁকি দিয়ে। আর দেশে প্রবেশের পর এসব পণ্যের দামও নেয়া হচ্ছে মূল দামের কয়েকগুণ বেশি। সব ধরনের পার্টস প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হলেও সেগুলোর গায়ে কোনো মূল্য লেখা নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিচ্ছেন।
পাইকারি বাজারে প্রতিযোগিতা থাকায় সীমিত লাভ করলেও খুচরা পর্যায়ে তা চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। আর মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় উচ্চ মূল্যে যন্ত্রাংশ কিনেও প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। রাজধানীর চানখারপুলের মোটরসাইকেল মেরামতকারী রাসেল আহমেদ বলেন, মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ কিনে অধিকাংশ ক্রেতাই প্রতারিত হচ্ছেন। আসল প্যাকেটে ভরে চড়া দামে নকল পণ্য বিক্রি করছেন অনেক ব্যবসায়ী। ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ক্রেতাকে।

মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী ডা. আবু নাসের দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, প্রায়ই মোটরসাইকেলের টিউব লিকেজ হচ্ছে। কিছুদূর চালানোর পর পুরো টিউবই ফেলে দেয়া হচ্ছে। এ টিউবের দাম স্থানভেদে আলাদা। ২৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দাম রাখা হচ্ছে। শুধু টিউবই নয়, অন্যান্য যন্ত্রাংশও ভিন্ন ভিন্ন দামে কিনতে হচ্ছে। অথচ চড়া দামে কিনলেও ব্যবহারে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায়ই নষ্ট হচ্ছে আর ছুটতে হচ্ছে মেরামতের জন্য।
সার্বিক বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক তাহের জামিল বলেন, মোটর পার্টসগুলোর গুণমান কিংবা মূল্য দেখভাল করা উচিত। এজন্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে কারিগরি ও জনবল সহায়তা বাড়াতে হবে।
আরও বলা হয়, সরকারের প্রতি আস্থা রেখে পিএইচপি ফ্যামিলি দেশে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়ার বিখ্যাত প্রোটন কোম্পানির কারিগরি সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ একটি অটোমোবাইল (মোটরকার) সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছে। বর্তমানে এ কারখানা থেকে সম্পূর্ণ দেশে তৈরি ব্র্যান্ড নিউ প্রোটন-পিএইচপি কার বাজারজাত করা শুরু হয়েছে। এ কারখানায় গাড়ি তৈরির সব অত্যাধুনিক মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ স্থাপন এবং প্রচুর জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক পরিসরে পূর্ণাঙ্গ গাড়ি প্রস্তুত করা হলেও শুল্ককর কাঠামো ও উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ করায় বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশে তৈরি মোটরকার ও আমদানি করা রিকন্ডিশন্ড মটরকারের শুল্ককর কাঠামোয় তেমন কোনো পার্থক্য নেই, বরং উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ মূসক বোঝার কারণে বিনিয়োগ হুমকির মুখে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ার বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান প্রোটন-এর সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনায় দেশে প্রথম সেডান কার উৎপাদন শুরু করে পিএইচপি ফ্যামিলি। প্রায় চারশ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৩০ একর জায়গার ওপর কারখানা স্থাপিত হয়েছে। দেশে প্রতিবছর ১৪-১৫ হাজার গাড়ি আমদানি হয়ে থাকে, যার প্রায় ৭০ শতাংশই সেডান কার। প্রায় ৯৮ শতাংশ পুরোপুরি প্রস্তুতকৃত গাড়ি দেশে আমদানি করা হয়। দুই থেকে তিন শতাংশ গাড়ির ইঞ্জিনসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ দেশে সংযুক্ত করে পুরোপুরি গাড়ি প্রস্তুত করা হয়।

এ বিষয়ে পিএইচপি ফ্যামিলির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহসিন সংগ্রামকে বলেন, গাড়ি আমদানি করলে যে পরিমাণ শুল্ক-কর দিতে হয়, আমাদের করও প্রায় কাছাকাছি নিয়ে গেছে সরকার। আমদানি করা গাড়িতে আমদানিকারকের কোনো বিনিয়োগ নেই। গাড়ি দেখে, এলসি খুলে গাড়ি এনে শো-রুমে ফেলে রাখে। অনেক সময় শো-রুমে না এনে বন্দরেই বিক্রি করে দেয়। যেহেতু তাদের কোনো অবকাঠামো নেই, সেহেতু তারা ভ্যালু অ্যাড করছে না। আমরা ভ্যালু অ্যাড করছি। এতে আমদানি করা গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমরা টিকে থাকতে পারব না।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয়ভাবে গাড়ি উৎপাদনে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে, আরও হবে। প্রায় চার শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়া একটি গাড়ি বানাতে কম হলেও তিন হাজার যন্ত্রাংশ লাগে। এজন্য আগামীতে বিনিয়োগ হবে। তাই আমাদের যদি শুল্ককর সুবিধা দেয়া না হয়, তাহলে এ খাত এগোবে না। এজন্য একটি সমন্বিত করনীতি প্রণয়ন এবং সরকারি সহায়তার সুপারিশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, শুধু মোটরকার নয়, দেশে যেকোনো ভারী শিল্প স্থাপনে সব সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া রফতানিতে প্রণোদনা দেওয়া হবে। দেশে গাড়ি উৎপাদন করা হলে দেশের অর্থনীতি বড় হবে, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়বে। পিএইচপিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গাড়ির মতো বড় শিল্প স্থাপনে এগিয়ে এসেছে। এ খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে সরকার কর বিষয়ে ছাড় দেবে। তিনি বলেন, গাড়ি সংযোজন ও উৎপাদনকে আমরা উৎসাহিত এবং আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে চাই।

http://www.dailysangram.com/post/328545