২৯ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার, ১১:৫৫

তেরো ভুলের অর্থভেদ

চলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে গিয়ে সেখানকার বাংলাদেশীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। তাতে তিনি বেশ ক্ষুব্ধই হয়েছেন বলে মনে হয়। আর সম্ভবত তিনি এই প্রতিরোধের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেই দায়ী করেন। আর সে জন্য তার ক্ষোভ অপ্রকাশিত থাকেনি। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা যা বলেন, তাই হয়। কিন্তু ব্রিটেন ভিন্ন দেশ। সেখানে শেখ হাসিনার মর্জিমাফিক কিছুই হয় না। কিংবা ব্রিটিশ সরকারের মর্জি অনুযায়ীও কিছু হয় না। যা হওয়ার, তা হয় আইন-কানুনের বিধান অনুযায়ী। কেন হয় না, তা নিয়েও তার ক্ষোভ আছে। সেখানে দেয়া বক্তব্যে সে ক্ষোভও প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পলাতক আসামি তারেক রহমানকে তার অপরাধের জন্য অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, তার সরকার তারেককে দেশে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাজ্যের সরকারের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারেককে আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আমরা অবশ্যই একদিন তাকে দেশে ফিরিয়ে নেব। তিনি তারেকের মতো সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে আশ্রয় দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের সমালোচনা করে বলেন, আমরা তাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাজ্য সরকারের সাথে কথা বলেছি। তিনি বলেন, ব্রিটেন একটি মুক্ত দেশ। যে কেউ এ দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে। তবে তারেক রহমান তো একজন পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তার অপরাধের জন্য আদালত তাকে সাজা দিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, যুক্তরাজ্য কেন এমন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আশ্রয় দিয়েছে। হাইকোর্টে একটি দুর্নীতির মামলায় তিন বছর আগে তাকে সাত বছর সাজা দিয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি মামলায় তারেকের বিরুদ্ধে আদালতে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। কয়েকটি ফৌজদারি ও দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি হওয়ায় তাকে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে। এ পলাতক আসামিকে কি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলো। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষোভ প্রকাশের পর অন্য আরেক নাটক ঘটল। একটি পত্রিকা তারেক রহমানের পাসপোর্টের ফটোকপি এবং ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি প্রকাশ করল। বলা হয়েছে, এই চিঠিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠিয়েছে, যা একেবারেই অসম্ভব। চিঠিটি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ইংরেজি ভাষায় লিখিত ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কথিত ওই চিঠিতে তেরোটি ভুল রয়েছে। মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ওই রকম একটি চিঠি কেউ তৈরি করে প্রচার করেছে।
এখন নানা ধরনের প্রচারণা চলছে। সরকারের একেক মন্ত্রী একেক কথা বলতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, তারেক রহমান তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষের পর সেটি লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে জমা দিয়েছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত এমনও বলছেন, যেহেতু তিনি পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন, অতএব তিনি আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের ডিজি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, পাসপোর্ট জমা দেয়ার সাথে নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু জমা দেয়া কেনÑ পাসপোর্টের সাথেই নাগরিকত্বের সম্পর্ক থাকে না। পাসপোর্ট একটি ভ্রমণ দলিল। এর মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করা যায়। বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে অন্তত ১০-১২ কোটি লোকের কোনো পাসপোর্টই নেই। তবে কি তারা বাংলাদেশের নাগরিক নন? এমন হাস্যকর কথা বলছেন মন্ত্রীরা যে, তারেক রহমান আর বাংলাদেশের নাগরিক নন। এখানেও বেশির ভাগ লোক গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, তারেক রহমান পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, যেহেতু তিনি পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন, অতএব তার নাগরিকত্ব রদ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কী কী কারণে একজন নাগরিক জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নাগরিকত্ব হারাতে পারেন এটাও তিনি জানেন না। এ ধরনের অনির্বাচিত সরকারে এ রকম লোকের মন্ত্রী পরিষদে থাকা সম্ভব, এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কথিত যে দু’লাইনের চিঠি বাংলাদেশ দূতাবাসে দিয়েছে, তাতে ভুল রয়েছে তেরোটি। প্রথমেই লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশি এম্বাসি’ যা ব্রিটেনের কোনো সরকারি দফতর লিখতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ‘হাইকমিশন অব বাংলাদেশ’। এখানে আছে দু’টি ভুল। তেমনি ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড এনডোর্সমেন্ট’ লেখাটায়ও ভুল আছে। ঠিকানার ভেতর কমা বসানো হয়নি। টেলিফোন নম্বরগুলোও অচেনা ও অকারণে বোল্ড করা হয়েছে। ২ জুন ২০১৪ কে লেখা হয়েছে ০২.০৬.১৪। অথচ ব্রিটিশ রীতিতে এভাবে লেখা হয় না। পত্রের সম্বোধনে আছে ‘ডিয়ার স্যারস’ প্রকৃত পক্ষে তা হবে ‘ডিয়ার স্যার’। লেখা হয়েছে ‘এনকোজড এ পাসপোর্ট’ প্রকৃতপক্ষে তা হবে এনকোজেড পাসপোর্টস’। থ্যাংক ইউ এর পর একটি ফুল স্টপ হবে। কিন্তু সেটিও নেই। আছে ইওরস ফেইথফুলি, সেখানে এফ-টি দেয়া হয়েছে বড় হাতের। প্রকৃতপক্ষে ফেইথফুলি’র এফ হবে ছোট হাতের। চিঠিতে একটি স্বাক্ষর আছে। কিন্তু স্বাক্ষরকারীর কোনো নাম নেই। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা কিছুতেই এত বড় ভুল করতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে যে এই চিঠিটি সম্পূর্ণ বানোয়াট। এ রকম একটি চিঠি নিয়ে মাতামাতিও ভালোই হয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক শুরুতেই বলেছিলেন, যে যাই বলুক ব্রিটিশ আইনে তারেক রহমনাকে ফেরত পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, পাসপোর্ট থাকা না থাকার সাথে নাগরিকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছে, তারেক রহমান ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাসপোর্ট জমা দিয়ে ট্রাভল পারমিট নিয়েছেন। তার পরেও কথা চালাচালি চলছে। যার যা খুশি বলেই যাচ্ছে। ড. শাহদীন মালিক বলেন, যদি কোনো দেশ তার কোনো নাগরিকের জন্য নিরাপদ না হয়। রাজনৈতিক বা অন্যান্য কারণে তিনি সরকারের নির্যাতন বা নিপীড়নের শিকার হতে পারেন কিংবা সরকার রাজনৈতিক কারণে তাকে হয়রানি করতে পারে, তাহলে যেকোনো নাগরিক যদি পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম চান তাহলে ইংল্যান্ডে তা দেয়া হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্রিটিশ আইনে কাউকে ফেরত দেয়ার বিধান নেই। তিনি বলেন, যারা এই আইন সম্পর্কে জানেন তারা এ বিষয়ে কথা বলতেন না। পাসপোর্ট না থাকলে কারো নাগরিকত্ব থাকে না, তা-ও নয়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের পাসপোর্ট নেই। কিংবা কেউ পাসপোর্ট জমা দিলে তার নাগরিকত্ব চলে যায় তা-ও নয়। ইউরোপে দীর্ঘকাল কাটানোর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. শাহদীন মালিক আরো বলেন, ব্রিটেনে অবস্থানকারী অন্য কোনো দেশের নাগরিক যদি জানান যে তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হলে নিপীড়নের শিকার হতে হবে, নিগৃহীত হতে হবে, তা হলে তাকে আর ফেরত পাঠানো হয় না। বাংলাদেশ সরকার চাইলেও তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না। উদ্ভূত অবস্থায় ড. শাহদীন মালিক মনে করেন না যে, তারেক রহমানকে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। তার পরেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই মুহূর্তে তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিক নন। যদি নাগরিকত্ব না-ও থেকে থাকে তাহলেও মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের আওতায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি বলেন, দেশের বাইরে গেলে নিজ দেশের পাসপোর্টই নাগরিকত্বের মূল দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের জন্য তার পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। তার মানে তারেক রহমান আপাতত বাংলাদেশের নাগরিক থাকতে চান না। আমার তো মনে হয়, এই ডামাডোল আরো কিছু দিন চলবে। সবটাই হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট রাখার কৌশল। যাতে ভবিষ্যতেও এমপি ও মন্ত্রী পদ বহাল থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এর আগে কানাডার উদ্দেশে বলেছিলেন, কানাডা যদি খুনিদেরই আশ্রয় দেয়, তাহলে বাংলাদেশের কারাগারে আটক সব খুনিদের কানাডায় পাঠিয়ে দেয়া উচিত। তিনি উপলব্ধি করতে চাননি কানাডায়ও একই ধরনের আইন রয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তিকে জোর করে তার দেশে ফেরত পাঠানো হয় এবং সেখানে যদি তার মৃত্যুদণ্ড বা নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে কানাডা কোনো অবস্থাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার দেশে ফেরত পাঠাবে

তারেক রহমান ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দফতরে পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। তারপর চার বছর কেটে গেছে। সরকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বহু রকম বিষোদ্গার করেছে। শত মুখে তার নিন্দা-মন্দ করেছে। কিন্তু এই চার বছরে কখনোই তার নাগরিকত্বের প্রশ্ন তোলেনি। সরকারের অজানা থাকার কথা নয় যে, তত দিনে তারেক রহমানের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং তিনি তা নবায়ন করতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাসপোর্ট জমা দেননি। সরকারের মধ্যে কেউ হয়তো এই আইন সম্পর্কে অবগত ছিলেন। যেমন পাসপোর্টের ডিজি। ফলে সরকার চুপ করেছিল। কিন্তু ব্রিটেনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান ও আচরণের ফলে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশে যা খুশি তাই করা যায়। গুম, খুনের মতো ব্যবস্থাও এখানে নেয়া যায়। পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে সেটি যে করা যায় নাÑ সরকারের ভেতরে এই বোধ জাগরিত হলে ভালো হয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/314136