২৮ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৮:১৯

অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে

বেশিরভাগ আসছে ভারত থেকে : নেপথ্যে ১২৮ সিন্ডিকেট : তুচ্ছ ঘটনায় ব্যবহার : ৫ মাসে ঢাকায় শতাধিক গুলির

দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এটি শুধু রাজধানী বা জেলা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ যে কোনো তুচ্ছ ঘটনায় অস্ত্রের ব্যবহার করছে দলীয় সন্ত্রাসীরা। ৩০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কয়েকটি বিশেষ রাষ্ট্র থেকে প্যাকেটজাত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র আনছে। কয়েক হাত হয়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। তবে বেশিরভোগ অস্ত্র আসছে ভারত থেকে। বাংলাদেশে কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেই। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার বিডিপিসির গবেষণাসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ১২৮টি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ঘটনায় সেখানে কমান্ডো অভিযান শেষে অত্যাধুনিক ৫টি পিস্তল, ৩টি একে-২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত শক্তিশালী গ্রেনেডের ৯টি সেইফটি পিন ও ৩০০ রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়। অত্যাধুনিক ভয়ঙ্কর এ অস্ত্রশস্ত্র দেশে এসেছে গোপন পথে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে। গত ২২ এপ্রিল রোববার বিকালে রাজধানীর বাড্ডা থানার বেরাইদ এলাকায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রæপের গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। ঢাকা-১১ আসনের এমপি ও বেরাইদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থকদের মধ্যে এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তবে উভয়পক্ষই এ ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ী করেছে। নিহত কামরুজ্জামান দুখু (৩৫) বেরাইদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাড্ডা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের ভাই। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় মহানগর ছাত্রলীগের দুই নেতা প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। ইতোমধ্যে পুলিশ ওই দুই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার র্যা ব-পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। এতে করে জনমনে আতঙ্ক বেড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) আবদুল কাইয়ুম বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিলে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অবৈধ অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম বাড়তেই থাকবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী। তিনি বলেন, যারা কথায় কথায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে তারা প্রভাবশালী এবং নিজেদেরকে আইনের উর্ধ্বে মনে করে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, দেশে এখন যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি। আগে দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেলেও এখন কমে গেছে। নতুন চকচকে এসব অস্ত্রের বেশিরভাগই আসছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। দেশের ১৮টি জেলার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব অবৈধ অস্ত্র আসছে। ইদানিং আবার অনলাইনেও অস্ত্র বেচাকেনা চলছে।
মাসখানেক আগে রাজধানীর সবুজবাগ থেকে ৩টি বিদেশি পিস্তলসহ চারজন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানায়, যশোর সীমান্ত থেকে অস্ত্র কিনে এনে তারা ঢাকায় বিক্রি করে। ৭ পয়েন্ট ৬৫ বোরের পিস্তলগুলো তারা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে। বেশির ভাগ ভারত ও পাকিস্তানের তৈরি। রাজধানীসহ সারা দেশে এখন ভয়ঙ্কর সব অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মিলছে আগ্নেয়াস্ত্র। সহজেই চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে। প্রতিনিয়ত হাতবদলও হচ্ছে এসবের। ভাড়ায় খাটছে অনেক অবৈধ অস্ত্র। এমনকি বৈধ অস্ত্রধারীরাও তাদের অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছেন সন্ত্রাসীদের কাছে। আবার ভুয়া লাইসেন্স দেখিয়েও অস্ত্র কিনছে অনেক সন্ত্রাসী চক্র। এমন এক পরিস্থিতিতে জঙ্গি থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব সন্ত্রাসীর হাতে এখন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র শোভা পাচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় উঠতি মাস্তানরাই শুধু নয়, ছিঁচকে ছিনতাইকারীরাও ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। ৩০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্র। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে কেনা ক্ষুদ্রাস্ত্র রাজধানীতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে দেশের অন্তত ৩০টি সীমান্ত রুট দিয়ে ঢুকছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্রের চালান। ভয়ঙ্কর একে সিরিজের অস্ত্র আসছে সমুদ্রপথে। ভারত, মিয়ানমার হয়ে দেশে আসা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। এ কারণে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত ঘটছে গোলাগুলির ঘটনা। গত পাঁচ মাসে রাজধানীতেই শতাধিক গুলির ঘটনা ঘটে। স¤প্রতি পৃথক কয়েকটি অভিযানে ডিবি ও থানা পুলিশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এসব অস্ত্র ঢাকায় এনেছিল। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে সাত বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সারাদেশে নিহত হয়েছে ৫৫ জন। এসব কোন্দলে ব্যবহার হয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর গুলিস্তানে ফুটপাতের অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় মহানগর ছাত্রলীগের দুই নেতা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। তারা হলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন ও ওয়ারী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান। তাদের অস্ত্রবাজির ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশাসনের টনক নড়ে। ঘটনার একদিন পর তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। এরপর মামলা হতে আরও দুদিন লাগে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা বিদেশ থেকে অস্ত্র আনছে। এজন্য বিপুল পরিমান টাকা ব্যয় হলেও আয়ের উৎস থাকায় তারা মোটা অংক খরচ করেই অস্ত্র কিনছে। চাহিদার কারণেই সংঘবদ্ধ একাধিকচক্র বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে প্যাকেটজাত নতুন অস্ত্র আনছে। বিভিন্ন পন্থায় সেগুলো চলে যাচ্ছে হাতে হাতে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দেশের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, স›দ্বীপ, সীতাকুন্ডু, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সাবরুম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি ও সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ অস্ত্র আসছে।
সূত্র জানায়, সীমান্তপথ দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ভুয়া লাইসেন্স দিয়েও অস্ত্র বেচাকেনা চলছে। স¤প্রতি এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, কক্সবাজারের বাসিন্দা ফজলুল করিম ও সাহাবুদ্দিন নামে দুই ব্যক্তি রাজধানীর পল্টনের একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান থেকে লাইসেন্স দেখিয়ে একটি এনপিবি পিস্তল কিনে নিয়ে যায়। লাইসেন্সটি পরীক্ষা করে না দেখলেও পরে এর মালিক কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন লাইসেন্সটি ভুয়া। একই ব্যক্তি পরে আবারও লাইসেন্সের নাম বদলিয়ে আরেকটি অস্ত্র কিনতে এলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচার অভিযোগও রয়েছে অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। গত বছর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এমন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারও করেছিল। এ ছাড়া রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে বৈধ অস্ত্র বাগিয়ে নিলেও তা ভাড়ায় খাটানো হয়। এমর অভিযোগের জলজ্যান্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নুর হোসেন। তার নিজের লোকজনের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল, যা দিয়ে তিনি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে।

এদিকে, এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৩৫ জেলায় ৪৬২ জন অস্ত্র ব্যবসায়ী সক্রিয়। এর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৪, চট্টগ্রামে ৪৮, ঢাকায় ৩৪, বান্দরবানে ২৬, কক্সবাজারে ২০, কুমিল্লায় ২০, মেহেরপুরে ১৮, নারায়ণগঞ্জে ১৩, টাঙ্গাইলে ১৪, সাতক্ষীরায় ১৪, রাজবাড়ীতে ৮, ফরিদপুরে ৪, গোপালগঞ্জে ৫, নেত্রকোনায় ১০, শেরপুরে ১৩, সিলেটে ১০, সুনামগঞ্জে ৮, হবিগঞ্জে ৮, খুলনায় ২, যশোরে ১১, নড়াইলে ৬, ঝিনাইদহে ৪, চুয়াডাঙ্গায় ১৩, কুষ্টিয়ায় ১১, রংপুরে ৪, লালমনিরহাটে ৫, দিনাজপুরে ৯, রাজশাহীতে ১২, নাটোরে ৬, নওগাঁয় ২, জয়পুরহাটে ১৫, বগুড়ায় ৪, ফেনীতে ১২, খাগড়াছড়িতে ৮, ও রাঙামাটিতে রয়েছেন ১১ জন।

https://www.dailyinqilab.com/article/128588