২৮ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৮:১৫

জনশক্তি রফতানিতে অশনি সঙ্কেত

প্রথম তিন মাসে কমেছে ১ লাখ ; সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি মালয়েশিয়ার বাজার ; খুলছে না বাহরাইনের বাজার

২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক ১০ লক্ষাধিক শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমালেও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই তা কমতে শুরু করেছে। গত বছর যেখানে দেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবে সাড়ে ৫ লাখেরও বেশি শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিলেন, এবার সেখানে তিন মাসে গিয়েছেন মাত্র ৮৫ হাজার কর্মী। এর মধ্যে অনেক কর্মী যাওয়ার পর থেকেই আকামা সমস্যা ও কাজ না পেয়ে বেকার অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

শুধু সৌদি আরব নয়, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, কাতারসহ শ্রমবান্ধব অন্যান্য দেশেও গত বছরের তিন মাসের তুলনায় চলতি বছর প্রায় এক লাখ শ্রমিক কম গেছে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ বাহরাইনে শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে। কী কারণে দেশটিতে কর্মী যাচ্ছে না এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাক। এই দেশটিতে সারা বছর যুদ্ধ লেগে থাকলেও দেশটির দূতাবাস থেকে চাহিদাপত্র বেশি আসতে শুরু করেছে। তবে বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এ দিকে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার সহস্রাধিক সাধারণ সদস্য মালয়েশিয়ায় এখনো পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে না পেরে চরমভাবে ক্ষুব্ধ। ‘জি টু জি প্লাস’ (সরকার টু সরকার+ রিক্রুটিং এজেন্সি) পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগী এজেন্সী মালিকেরা বলছেন, তারা সরকারের কাছে লাখ লাখ টাকা জামানত রেখে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়েছেন। তারপরও মালয়েশিয়ায় তাদের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যস্থতায় ‘দালাল’ হিসেবে কর্মী পাঠাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুত এর সমাধান এবং সবাইকে সমানভাবে কর্মী পাঠানোর দাবি জানান।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা যায় চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ ৮ হাজার ২৫ জন শ্রমিক বিদেশে যান। তার মধ্যে শুধু সৌদি আরবে গিয়েছেন ৫ লাখ ৫১ হাজার ৩০৮ জন। বাংলাদেশের শ্রমিক রফতানিতে এই পরিমাণ শ্রমিক বিদেশে আর কখনো যাননি। সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর টার্গেট নির্ধারণ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খায় মন্ত্রণালয়।

ব্যুরোর তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিদেশে মোট কর্মী গিয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ২০১ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৮১ হাজার ৮৪৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯ হাজার ৩৮২ জন ও মার্চ মাসে গিয়েছে ৬২ হাজার ৯৭৩ জন। যদিও এই তিন মাসে টার্গেট মোতাবেক তিন লাখ কর্মী যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে এই সময়ের মধ্যেই এক লাখ কর্মী কম গেছে। অপর দিকে গত বছর নারী কর্মী গিয়েছিলেন ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন। কিন্তু চলতি বছর প্রথম তিন মাসে গিয়েছেন ২৮ হাজার ৬৩৬ জন। এখানেও তুলনামূলকভাবে কম গেছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১২ হাজার ২৪৯ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৯ হাজার ৫০৯ জন আর মার্চ মাসে কমে গেছে ৬ হাজার ৮৭৮ জন।

বাহরাইনে ২০১৭ সালে মোট শ্রমিক গিয়েছেন ১৯ হাজার ৩১৮ জন। কিন্তু এ বছরের প্রথম তিন মাসে গেছে মাত্র ৩৯১ জন। তবে ব্যতিক্রম ইরাকে। ২০১৭ সালে মোট ৩ হাজার ৮১৯ জন শ্রমিক গেলেও এবার মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ৪ হাজার ৫৫৯ জন শ্রমিক চলে গেছেন। ইতোমধ্যে দেশটির দূতাবাস থেকে হাজার হাজার চাহিদাপত্র সত্যায়ন করে কিছু এজেন্সি নিয়ে এসেছে। এসব শ্রমিকের বিপরীতে নিয়োগানুমতি দেয়ার আগে চাহিদাপত্র পুনরায় যাচাই-বাছাই করে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান অভিবাসন বিশেষজ্ঞেরা। কারণ দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক।

গতকাল জনশক্তি রফতানির সাথে সম্পৃক্ত বোরহান নামের এক এজেন্সির প্রতিনিধি নয়া দিগন্তকে বলেন, মন্ত্রী মহোদয় এ বছর ১২ লাখ শ্রমিক পাঠানোর যে টার্গেট দিয়েছেন তার অর্ধেক এ বছর যেতে পারে কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান। আর সৌদি আরবে গ্রুপ ডিমান্ডে যাওয়া শ্রমিকেরা কিছুটা ভালো থাকলেও ফ্রি ভিসার নামে যেসব শ্রমিক এখনো একক ভিসায় বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগেরই এখন সেখানে চাকরি নেই। এর মধ্যে যেসব গ্রুপ ভিসার বিপরীতে একক ছাড়পত্র নিতে গিয়েও পারছে না, তারা ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার ভয়ে ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ করে পাঠিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সব মিলিয়ে শ্রমবাজারের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে অভিমত জানিয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট না ভাঙতে পারলে শ্রমিক পাঠানোর গতি বাড়বে না। একইভাবে আবুধাবি, সৌদি আরবের শ্রমবাজারে যদি নতুন করে কোনো সিন্ডিকেট হয়ে যায় তাহলে আবারো পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।

গতকাল জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, মালয়েশিয়ায় যেসব শ্রমিক যাচ্ছেন, সব শ্রমিকই যাচ্ছেন ১০ এজেন্সির মাধ্যমে। তবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর যেসব শ্রমিক সমস্যায় পড়ছেন সেগুলোর ব্যাপারে অভিযোগ পাওয়ার পরই আমরা সাথে সাথে অ্যাকশনে যাচ্ছি। আল ইসলাম ওভারসিসের পাঠানো ৩৯ শ্রমিকের সমস্যায় থাকা প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, শ্রমিক পাঠিয়ে যারাই সমস্যায় রাখবেন তাদের কেউ রেহাই পাবে না। তারা যতই ক্ষমতাশালী হোন। এ প্রসঙ্গে আল ইসলাম ওভারসিসের স্বত্বাধিকারী জাফর ইসলাম গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তকে বলেন, তার অফিস থেকে পাঠানো শ্রমিকেরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর থেকে সমস্যায় রয়েছেন। এমনটি স্বীকার করে তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে ওই কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য হাইকমিশন থেকে দেশটির সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। অপর দিকে সমস্যায় পড়া শ্রমিকদের অন্য কোম্পানিতে রিপ্লেস করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/313937