২৮ এপ্রিল ২০১৮, শনিবার, ৮:১৪

সড়ক দুর্ঘটনা দায় কার

মালিকের টার্গেটের কারণে দুর্ঘটনা : চালক ; বেশির ভাগ চালক মাদকাসক্ত : মালিক ; পথচারীদের দায় কম নয় : মালিক ও চালক

মালিকের বেঁধে দেয়া টার্গেট পূরণ করতেই বেপরোয়া বাসচালকেরা। টাকার জন্য তাদের পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। আর এতেই ঘটে যত দুর্ঘটনা। কার আগে কে যাত্রী তুলবে সেই মানসিকতা নিয়েই রাজধানীতে গাড়ি চালায় চালকেরা। চালকেরা বলেছেন, মালিকের টার্গেট পূরণ করতে না পারলে শ্রমিকদের না খেয়ে থাকতে হয়। যে কারণে রাস্তায় নামলে টাকা উপার্জন ছাড়া তাদের মাথায় আর কিছু থাকে না। মালিকদের বিরুদ্ধে এমনটিই অভিযোগ চালকদের।

এ দিকে মালিকদের অভিযোগ ভিন্ন। তাদের মতে চালকদের টার্গেট দেয়া হয় চুরি ঠেকাতে। দিনচুক্তি হিসেবে না দিলে বাড়িঘর বেচে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে হবে, বলেন তারা। জাফর আহমেদ নামে ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের একজন বাস মালিক বলেন, লাইনে বাস ঢুকাতে প্রতিদিন টার্মিনালে লাইনম্যানদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়। নতুবা বাসের চাকা ঘুরবে না। তার ওপর ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির কিস্তি তো রয়েছেই। ৯০ ভাগেরও বেশি বাস ব্যাংক থেকে লোনে কেনা। কাজেই মালিকদের পেট চলুক আর না চলুক কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত জমা না থাকলে চালক ও হেলপারদের গরজ থাকে না। তার ওপর টাকা চুরির বিষয়টিতো আছেই। একটু উনিশ-বিশ হলে জানিয়ে দেয় ইঞ্জিনে সমস্যার কারণে গাড়ি চলছে না। অথবা যানজটের কারণে ট্রিপ কম হয়েছে। তিনি বলেন, রিকশা, সিএনজি, ট্যাক্সিক্যাব থেকে শুরু করে সব গণপরিবহনেরই নির্ধারিত জমা সিস্টেম। তাহলে বাসের হলে তাতে দোষ কোথায়। তিনি আরও বলেন, সারা দেশে বাসচালক ও হেলপারদের ৮০ ভাগই মাদকাশক্ত। মূলত সে জন্যই তারা দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে চালকদের বক্তব্য মালিকদের বিপরীত। তাদের অভিযোগের তীর মালিকদের বিরুদ্ধে।

অপর দিকে যে বিষয়টি নিয়ে মালিক ও চালক উভয়পক্ষ জোর গলায় বলেছেন, তা হচ্ছে, রাস্তায় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পথচারীদের অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী।
ফরিদ উদ্দিন। রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল রুটে গাড়ি চালান। তিনি বলেন, পরিবহন মালিকেরা ভাড়ার একটা টার্গেট ধরে দেয়। ওই টার্গেট অনুযায়ী মালিককে টাকা দিতে হয়। না হলে পরদিন আর গাড়ি পাওয়া যায় না। অন্য ড্রাইভারকে গাড়ি দিয়ে দেয়। গাড়ি চালাতে না পারলে আর খাবার জোটে না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। টার্গেট পূরণের পর যে টাকা আয় হয় তার ভাগাভাগি হয় চালক, সুপারভাইজার আর হেলপারের মধ্যে। ফরিদ উদ্দিন বলেন, আগে ড্রাইভাররা বেতনে গাড়ি চালাত। এখন তাদের চুক্তিতে নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। কোনো কোনো দিন যায়, যেদিন মালিকের টার্গেট পূরণই সম্ভব হয় না। সে দিন না খেয়ে থাকতে হয়। যে কারণে ড্রাইভাররা সব সময় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়। কার আগে কে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা করতে হয়। আগে না গেলে যাত্রী পাওয়া যাবে না। আর এ কারণেই দেখা যায়, পাল্লা দিতে গিয়ে পথচারীদের হাত-পা চলে যাচ্ছে; কেউ কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। ফরিদ উদ্দিন বলেন, মালিকের এ টার্গেটপ্রথা বাতিল না হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
বাবুল নামে এক চালক বলেন, মালিকদের টার্গেট পূরণ করা সম্ভব না হলে গালাগালি তো রয়েছেই। মাঝে মধ্যে মার খেতে হয়। এ মার খেয়েও পরদিন চালকেরা গাড়ি নিয়ে বের হতে বাধ্য। না হলে না খেয়ে মরতে হবে।

এ দিকে একাধিক মালিক বলেছেন, তারা বাধ্য হয়ে এভাবে চুক্তিতে গাড়ি দেন। বেতনে গাড়ি দিলে চালকেরা তাদের ইচ্ছামতো চালায়। তাতে মালিকদের পথে বসার উপক্রম হয়। এক হাজার টাকা ভাড়া আদায় হলে হিসাব দেয় পাঁচ টাকার। তাতে প্রতিদিন লস হয়। যে কারণে মালিকেরা যুক্তি করে এখন চালকদের কাছে গাড়ি ভাড়া দেয়। চালকেরা তার চেয়ে যত বেশি তুলে নিতে পারে তাতে মালিকদের কোনো আপত্তি নেই।
গত এক মাসে অন্তত পাঁচ জনের হাত-পা চলে গেছে দুর্ঘটনায়। যেগুলো ছিল খুবই মর্মান্তিক। এর মধ্যে ঢাকায় দুই বাসের পাল্লায় রাজিব নামে এক শিক্ষার্থীর হাত কেটে রাস্তায় পড়ে থাকে। আহত অবস্থায় রাজিবকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বেসরকারি সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তাদের হিসাব অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীতে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগের জন্য দায়ী দুই বাসের মধ্যে পাল্লা দেয়া। কে কার আগে যাবে; এ পাল্লা দিতে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। রাস্তায় দাঁড়ালেই দুই বাসের এ পাল্লা দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে।

পরিবহন নেতা আলী রেজা বলেন, মালিকেরা টার্গেট দিয়ে গাড়ি দেয়। কিন্তু এর বাইরেও রাস্তায় অনেক টাকা খরচ রয়েছে। তা মালিকেরা বহন করে না। রাস্তায় চাঁদা দিতে হয়, পুলিশকে টাকা দিতে হয়; যার হিসাব মালিকেরা রাখে না। তারা তাদের টার্গেট পূরণে ব্যস্ত। টার্গেট পূরণ করতে না পারলে সেই চালককে গাড়ি দেয়া হয় না। ফলে চালকেরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় প্রতিযোগিতায় নামে; কে কার আগে যাবে। আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/313920