৩ এপ্রিল ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩৩

মশার ‘কারখানা’ ভাঙে না কেউ

রাজধানীর রামপুরা-বনশ্রী খাল এখন আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। পুরো এলাকার পানি নিষ্কাশনের এ খালটির বনশ্রী সি-ব্লক থেকে মেরাদিয়া হাট পর্যন্ত অংশ মশা উৎপাদনের ‘কারখানা’ হিসেবে পরিচিত। মশার উৎপাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ বনশ্রীর এইচ-ব্লকের ৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা পরিমল কুমার বলেন, ‘রাজধানীর সব এলাকার চেয়ে বনশ্রীতে মশা বেশি। মশা উৎপাদনের কারখানা রামপুরা খালটির কারণে এত মশা। মেরাদিয়া হাটে কেনাকাটা করতে গেলে শরীরে একসঙ্গে কয়েক শ মশা বসে। শরীর নড়াচড়া করেও মশা সরানো যায় না। সিটি করপোরেশনের উচিত মশার ওষুধ ছিটানোর সঙ্গে সঙ্গে উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা।’

রাজধানীতে মশার উৎপত্তিস্থল বাড়ায় এর উৎপাত বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ডোবা, নালা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেখানে মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে। বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নিয়মিত পরিষ্কার না করায় নিচু জমি, ঝিল, লেক ও পুকুরগুলো আবর্জনায় ভরে উঠেছে। এগুলো হচ্ছে মশার মূল প্রজননস্থল। কিন্তু ওই সব স্থান পরিষ্কারও করা হয় না, সেখানে ওষুধও ছিটানো হয় না। প্রজননস্থল বাদ রেখে অন্যান্য এলাকায় ওষুধ ছিটানোয় কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা। জানা যায়, রাজধানীর খাল, লেক, ডোবা-নালা, পুকুর ও জলাশয় পরিষ্কার করার দায়িত্ব হলো ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শেখ সালাউদ্দিন অবশ্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেখানে মশা ডিম পাড়ে সেসব স্থানে আমরা ওষুধ ছিটাই। কিন্তু অনেক সময় বাসাবাড়িতে প্রবেশ করা যায় না। ফলে তা ওষুধ ছিটানোর বাইরে রয়ে যায়।’ সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি অন্য সংস্থাগুলোকে তাদের দায়িত্বে থাকা মশার উৎপাদনস্থলগুলো পরিষ্কার করার আহ্বান জানান তিনি।

রাজধানীর মাদারটেক, নন্দীপাড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কালশী, ভাসানটেক, কল্যাণপুর, দারুসসালাম, নাখালপাড়া, মহাখালী, বাসাবো, খিলগাঁও, মুগদা, মানিকনগর, শনির আখড়া, মীর হাজারীবাগ, বছিলা এলাকায় মশার উৎপাত বেশি। ওই সব এলাকায় ডোবা-নালা ছাড়াও বেশ কিছু খাল ও ছোট ঝিল রয়েছে। খালগুলোতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পচা পানি মশার প্রজননকেন্দ্র হয়েছে। ঝিলেও কচুরিপানা আর ময়লা পচে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ওই সব খাল-ঝিল পরিষ্কারও করা হয় না, সেখানে ওষুধও ছিটানো হয় না।

কালশী রোডের কাছ থেকে বাইশটেকী পর্যন্ত কালশী খাল ঘুরে দেখা যায় মশা আর মশা। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় ময়লার স্তূপ জমেছে। কালশী এলাকার মানুষ এ খালের মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ। একই অবস্থা দেখা যায় রূপনগর থানাসংলগ্ন ঝিলপাড় ডোবায়। ওই ডোবার একটি অংশ রূপনগর খালে গিয়ে মিশেছে। খালে পানির প্রবাহ না থাকায় আশপাশের বাসাবাড়ির ময়লা সেখানে জমাট বেঁধেছে। ওই খাল, ঝিল ও ডোবা মশার উৎস বলে জানায় স্থানীয় বাসিন্দারা।
ঢাকার খাল, ডোবা ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসন ওই সব খাল, ডোবা, নালা পরিষ্কার না করায় সেগুলো মশা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে মশার বংশ বিস্তার ঠেকাতে সিটি করপোরেশনও নিয়মিত ওষুধ প্রয়োগ করছে না।
জানা যায়, রাজধানীর ২৬টি খালের মধ্যে বেশির ভাগ ঢাকা ওয়াসার। বেশ কয়েকটি খালের মালিকানা ঢাকা জেলা প্রশাসনের। ফলে ঢাকা ওয়াসা সেগুলো পরিষ্কার করে না। বরাদ্দ পেলে মাঝে মধ্যে কচুরিপানা ও কিছু কঠিন বর্জ্য পরিষ্কার করে ওয়াসা। কয়েক মাস আগে বেশ কিছু খাল পরিষ্কার করার জন্য ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে ৬০ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। টাকা না পেয়ে ওয়াসা হাত গুটিয়ে বসে আছে। ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ওয়াসার খাল-ড্রেন রক্ষণাবেক্ষণ শাখা কোনো অর্থ বরাদ্দ পায় না। ফলে এসব খাল বা ড্রেন পরিষ্কারও করা যাচ্ছে না।’

ইব্রাহিমপুর খাল একসময় এলাকার পানি নিষ্কাশনের কাজ করলেও এখন খালটিতে ময়লা পানির ওপর শুধু মশা আর মশা চোখে পড়ে। ইব্রাহিমপুর বক্স কালভার্ট রোডের পাশে গিয়ে দেখা যায় পানিতে প্রচুর মশা ভাসছে। খালের আশপাশের বাসাবাড়িতেও মশার দৌরাত্ম্য।
খিলগাঁও-বাসাবো এলাকার বাসিন্দারাও মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। এলাকায় এত মশা কেন জানতে চাইলে ডিএসসিসির ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর কাজটি করছি। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কারণ মশার উৎপত্তিস্থল বেশি থাকায় প্রচুর মশা জন্ম নিচ্ছে। বাসাবো ও নন্দীপাড়া খাল এখন মশা তৈরির কারখানা। এসব খাল পরিষ্কার না থাকায় মশার উৎপাত বেড়েই চলেছে।’
একই অবস্থা দেখা যায় উত্তরা লেকেও। আবদুল্লাহপুর থেকে শুরু হয়ে উত্তরার বেশ কয়েকটি সেক্টরের মধ্য দিয়ে বাদশাটেক এলাকায় গিয়ে শেষ হওয়া লেকটি দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় মশার উৎস হয়ে উঠেছে। লেকটি রাজউকের মালিকানাধীন হওয়ায় এর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে না ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বা ওয়াসা। এ ছাড়া গুলশান লেকও রাজউকের মালিকানাধীন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে ওই লেকে গিয়ে দেখে যায় ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ভাসছে মশা। লেকের যেসব জায়গায় বাসাবাড়ির আবর্জনা পচে আছে সেখানেই মশার কারখানা। বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডে ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা যায় পানিতে ময়লার সঙ্গে মশার স্তূপ ভাসছে। লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে চাইলে শরীরে এসে ধাক্কা খায় অনেক মশা।

গুলশান লেকের দায়িত্বে থাকা রাজউকের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুর রহমান সুমন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লেক উন্নয়নে আমাদের যে অর্থ বরাদ্দ ছিল তা দিয়ে কাজ করা হয়েছে। এখন আর কোনো বরাদ্দ নেই।’ লেক পরিষ্কার করার জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ থাকে না বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, রাজধানীর বেশ কিছু পুকুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের মালিকানাধীন। সংস্থাটির পক্ষ থেকে যেসব এলাকায় আবাসিক ভবন গড়ে তোলা হয়েছে সেখানেই পুকুর বেশি। এমন একটি পুকুর আছে আজিমপুর এলাকায়। ওই পুকুরটি বৃষ্টির পানি ধারণের আধার বলা হলেও বাস্তবে এটি এখন আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করায় পুকুরটি এখন মশার প্রজননক্ষেত্র। একই অবস্থা রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মালিকানাধীন এলেনবাড়ী পুকুর ও মিরপুর টোলারবাগ আবাসিক এলাকার পুকুরটি। টোলারবাগ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা খায়রুল উদ্দিন জানান, পুকুরটি অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। এখন যেটুকু আছে তাও বেশ অপরিষ্কার। এখানে মশার ডিম ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

এ বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাৎ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পুকুরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। তবে প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী পুকুর পরিষ্কার করে এ অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে বিল হিসেবে দিতে পারেন।’
আবার সিটি করপোরেশনের ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। বেশ কিছু যন্ত্র পুরনো, সেগুলো এখন আর কাজ করছে না। ডিএসসিসিতে মশার ওষুধ ছিটানোর মেশিন রয়েছে ৯৪০টি। এর মধ্যে হাতে চালিত ৪৪২টি, ফগার মেশিন ৪৪৭টি এবং হুইল ব্যারো মেশিন রয়েছে ৫১টি। এসবের মধ্যে ২০৮টি হাতে চালিত মেশিন ও ১৮৬টি ফগার মেশিনে খুব একটা কাজ হয় না। আর ১৮টি হুইল ব্যারো মেশিন দিয়েও কাজ করা যাচ্ছে না।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে মশা একটু বেশি। এটি মূলত মৌসুমের জন্য। এ ছাড়া প্রজননের স্থানগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ায় প্রচুর মশা জন্ম নিচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকে মশার উৎপত্তিস্থলসহ সব স্থানেই ওষুধ ছিটানো হয়।’
জানা যায়, ডিএনসিসির ৬৫৩টি মেশিনের মধ্যে হাতে চালিত ৩৮৭টি, ফগার মেশিন ২৫৫টি ও হুইল ব্যারো মেশিন ১০টি। এ ছাড়া একটি ভেহিক্যাল মাউন্টেড ফগার মেশিন রয়েছে। এসবের মধ্যে শতাধিক মেশিন দিয়ে এখন আর কাজ করা যায় না। এ ছাড়া পুরনো মেশিনে অতিমাত্রায় শব্দ হওয়ায় মশা একস্থান থেকে অন্যস্থানে সরে যায়।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/04/03/620822