২ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ১০:১৪

সিআরআর হার কমিয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়া হচ্ছে

ব্যবসায়ীদের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতিস্বীকার

ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের বেশির ভাগই আদায় হচ্ছে না। আর যোগসাজশের পুরো ঋণই বকেয়া থেকে যাচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। বেসরকারি খাতে দৃশ্যমান বিনিয়োগ না হলেও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে ঋণপ্রবাহ। তাই আগ্রাসী বিনিয়োগ বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ আমানতের অনুপাত কমানো হয়েছিল; কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগ থামানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে না। আমানতকারীদের সুরক্ষায় আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআআর) ১ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করা হবে। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে বাজারে ১৩ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ছাড়া হবে। ব্যাংক বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, এর ফলে ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিং আরো বেড়ে যাবে। এতে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সিআরআর হার কমানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ, আগ্রাসী ব্যাংকিং ও ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে কিছু কিছু ব্যাংকের টাকার সঙ্কট ছিল; কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে গত ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল। সুতরাং মুষ্টিমেয় ব্যাংকের কারণে সিআরআর হার কমানো মোটেও যুক্তিসঙ্গত হয়নি বলে তিনি মনে করেন। দ্বিতীয়ত, সিআরআর হার কমানোর ফলে বাজারে নতুন করে টাকা ছাড়া হবে। এমনিতেই কিছু কিছু ব্যাংক আগ্রাসী বিনিয়োগ করছিল। ওইসব ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ বিতরণ করে। এখন নতুন করে বাজারে টাকা ছাড়া হলে ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিং আরো বেড়ে যাবে। বাছ বিচার না করেই ঋণ বিতরণ করা হবে। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়িয়ে ও খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ার দিকে ব্যাংক মনোযোগ দিলে সিআরআর হার কমানোর কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এ সিদ্ধান্ত একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত বলে মনে করেন তিনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে ঋণ আমানতের অনুপাত প্রচলিত ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশ ও ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে প্রথমে জুনে ও পরে ব্যবসায়ীদের চাপে তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ঋণ আমানতের অনুপাত কমানোর প্রভাবে বাজারে টাকার প্রবাহ কমে যায় বলে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। যদিও কাগজে কলমে গত ডিসেম্বরে ১২ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তহবিল ছিল। এরই জেরে সরকারি তহবিল ৫০ শতাংশ করে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে সিআরআর হার কমানোর দাবি জানানো হয়। ব্যাংক মালিকদের পক্ষ থেকে ৩ শতাংশ সিআরআর হার কমানোর দাবি জানানো হলেও গতকাল তা ১ শতাংশ কমানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মামলা, মকদ্দমাসহ নানা কারণে খেলাপি ঋণ আদায় হয় না; কিন্তু এখন ব্যাংকের খাতায় যেসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে ওইসব ঋণও আদায় হচ্ছে না। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এ প্রবণতা বেশি। সরকারি ৬ ব্যাংকের প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার নিয়মিত ঋণের মধ্যে তিন মাসে আদায় হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ কোটি টাকা। এটাকেই উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার অপসংস্কৃতি চালু হওয়ার কারণে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তারাও আগ্রাহ হারিয়ে ফেলছেন। নিয়মিত ঋণ আদায় না হলে এসব ঋণ শিগগিরই অনিয়মিত হয়ে যাবে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে। ফলে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের সক্ষমতা তলানিতে ঠেকবে। ব্যাংক ঋণের সুদহার আবারো বেড়ে যাবে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার মতো ঋণ পাবে না। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারিয়ে দেশী পণ্য মার খাবে বিদেশী পণ্যের কাছে। সবমিলে জাতীয় প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যাবে।

জানা গেছে, নিয়মিত, অনিয়মতিসহ সব ধরনের ঋণ আদায়ের চিত্র নিয়ে প্রতি তিন মাস অন্তর প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে গত জুন ভিত্তিক তথ্য নিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট নিয়মিত ঋণ রয়েছে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সামগ্রিকভাবে আদায় দেখানো হয়েছে ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর আদায়ের হার দুই অঙ্কের ঘরে অর্থাৎ ২০ শতাংশের মধ্যে থাকলেও সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। শুধু সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেই নিয়মিত ঋণ আদায় কমে যায়নি, কিছু কিছু বেসরকারি ব্যাংকের আদায়ের হার খুবই কম। যেমনÑ ১৩টি ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের এক টাকাও আদায় হয়নি ওই তিন মাসে। আর বাকি তিনটি ব্যাংকের আদায়ের হার ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গতকাল ব্যবসায়ী, ব্যাংকারদের, মালিকদের সংগঠন, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এক যৌথ বৈঠকে সিআরআর হার কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। আজ অথবা আগামীকাল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/306869