২ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ১০:১১

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা

# প্রতিদিন আত্মহত্যা করে ৩০ জন
# সবচেয়ে প্রচলিত কারণ মানসিক চাপ

দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা। ২০১৭ সালে সারাদেশে ১১ হাজার ৯৫ ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ৩০ জন মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে গত বছর সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রতিটি মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে কোনও না কোনও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তা তারা পান না। কারণ, তাদের পাশের প্রতিটি মানুষ এখন ব্যস্ত। এজন্য বাড়ছে আত্মহত্যা।

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখান বলছে, ২০১৭ সালে সারাদেশে ১১ হাজার ৯৫ জন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ফাঁসিতে ঝুলে সাত হাজার ৫৬৯ জন, বিষপানে তিন হাজার ৪৬৭ জন এবং গায়ে আগুন লাগিয়ে ৫৯ ব্যক্তি আত্মহত্যা করেন। বরিশালে গত বছর দুই হাজার ৫৮৫ জন আত্মহত্যা করেছেন বলে পুলিশের দেয়া তথ্য থেকে পাওয়া গেছে।

২০১৬ সালে সারাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ১০ হাজার ৬০০টি। ২০১৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৯৫টিতে। প্রতিবছর আত্মহত্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ সালে সারাদেশে ১০ হাজার ২০০ জন এবং ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৫০০ জন আত্মহত্যা করেন।
প্রতিবছর সারাদেশে যে পরিমাণ খুনের ঘটনা ঘটে, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালে খুনের ঘটনা ছিল চার হাজার ৫১৪টি, অথচ আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ১০ হাজার ২০০টি। একইভাবে ২০১৫ সালে চার হাজার ৩৬টি খুন হয়, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ১০ হাজার ৫০০টি। ২০১৬ সালে তিন হাজার ৫৯১টি এবং ২০১৭ সালে খুনের ঘটনা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৫৪৯টিতে।
বরিশালের পর ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে। এই বিভাগে গত বছর দুই হাজার ৫৮৫ জন আত্মহত্যা করেন। এরপর যথাক্রমে রংপুরে এক হাজার ৪৩৩ জন, সিলেটে এক হাজার ১৯৭ জন আত্মহত্যা করেন। অন্যান্য বিভাগেও এই সংখ্যা উদ্বেগের। রেলওয়ে রেঞ্জেও আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে গত বছর। তৃতীয় সর্বোচ্চ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে রেলওয়ে রেঞ্জে। এই রেঞ্জে এক হাজার ২৩১ জনের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বব্যাপীও আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (এইচডাবি¬উও) হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের যত মানুষ যুদ্ধবিগ্রহে মারা যায়, তারচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনায় মারা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড : অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’-এ বলা হয়, প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এই সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছুবে। একই প্রকাশনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা আরও বলছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যু প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে।

আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, একজন মানুষ যখন তাকে সহযোগিতা ও সমর্থন করার মানুষ চারপাশে পান না, তখন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, আত্মহত্যার সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হলো মানসিক চাপ ও বিষাদগ্রস্ততা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যন্ত্রণার স্থায়ী অনুভূতি এবং আত্মহত্যার মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার অনঢ় এক বিশ্বাস। একসময় বিষাদগ্রস্তমানুষটি মনে করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। আর তখনই তিনি আত্মহত্যা করেন।
ড. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জীবনধারণের যন্ত্রণা সব সময় তাকে চাপের মধ্যে রাখে এবং এই চাপ বহনে সে নিজেকে অক্ষম ও অযোগ্য মনে করে। আমাদের ব্যস্ততার কারণে সম্পর্ক ও সহযোগিতা কমে যাচ্ছে। আগে যেভাবে আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিশতাম, বেড়াতে যেতাম, এখন আর সেটা হচ্ছে না। এ কারণেই এসব ঘটছে।

এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে রাষ্ট্র ও পরিবারের ভূমিকা রাখতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে এসেছেন, এরকম অনেক ক্লাইন্টের চিকিৎসা আমি করছি। তাদের যখন জিজ্ঞাসা করি আপনি কেন আত্মহত্যা করতে চান? তারা যেসব সংকট ও অভাবের কথা বলেন, সেগুলো পূরণের চেষ্টা হলে দেখা গেছে ঝুঁকিটা কমে আসে। তাদের কথা শুনতে হবে। তাদের সময় দিতে হবে। তাহলেই আত্মহত্যার সংখ্যা কমে আসবে। এ জন্য সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।

দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে ‘স্কুল ফর সোস্যাল এন্টারপ্রিনারস’। সংস্থাটির সভাপতি শেখ মোহাম্মদ ইউসুফও মনে করেন, আত্মহত্যা রোধে সামাজিক বন্ধন ফিরিয়ে আনা জরুরি। তিনি বলেন, ‘এখন সবাই ঘরমুখী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও জীবনমুখী নয়। ফলে লেখাপড়া শেষে অনেকে বিষয় অনুযায়ী কাজের সুযোগ পান না। আবার অনেক পরিবার সন্তানের পছন্দ কিংবা মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পছন্দ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

http://www.dailysangram.com/post/324962