২ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ১০:০৬

ওমানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের মানবেতর জীবন

সুমন হোসেন (২৭)। কুমিল্লার বরুড়া থানাধীন জাপুরা গ্রামের বাসিন্দা। পিতা-মাতা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে একটু সুখে স্বাচ্ছন্দে রাখতে বছর দুয়েক আগে ওমানে পাড়ি জমান এই যুবক। হঠাৎ করে তার উপর নেমে আসে অমানিসার অন্ধকার। ফেরত পাঠানো হলো তাকে। কেন তাকে ফেরৎ পাঠানো হচ্ছে তারও জবাব পাননি তিনি। পেশায় ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। সাথে করে তেমন কিছুই আনতে পারেননি। সেখানে কাটিয়েছেন ২৩ মাস ৬দিন। ভিসার মেয়াদ ছিল আরও কয়েক মাস। সেখানকার সিভিল নাম্বার ১০৬৩৫১১২৯। আবারো যাওয়া ইচ্ছে ছিল। আবেদনও করা ছিল। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। উল্টো দেশে গিয়ে কি করবেন, কিভাবে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাবেন সেই চিন্তা তার চোখে মুখে। কথা গুলো বলতে বলতে দু’চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। আর বলছিল, কেন যে দেশ ছেড়ে বিদেশে গেলাম?

গত ২৬ মার্চ করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশানাল বিমানবন্দরে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় সুমন হোসেনের। ওমান থেকে কানেকটিং ফ্লাইটে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তার সাথে ওমান থেকে ফেরৎ পাঠানো হয় আরও ২৩ যুবককে। এদের মধ্যে কাউকে কাজে থাকা অবস্থায় ধরে এনে বিমানে তুলে দেয়া হয়েছে। কেউবা কারাগারে ছিলেন। এমন অবস্থায় তাদের ফেরৎ পাঠানো হয়েছে যেখানে অনেকেই পায়ের স্যান্ডেলটিও পরতে পারেনি। খালি পায়ে, কাজের সময় গায়ে থাকা পোশাকেই তাদের বিমানে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। উপস্থিত শ্রমিকরা জানান, কাজের পারমিট থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন বাংলাদেশী শ্রমিকদের ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারো কারো ঠিকানা হচ্ছে কারাগারে। তাদেরও একটা নির্দিষ্ট সময় পরে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন তাদের ফেরৎ পাঠানো হচ্ছে বা গ্রেফতার করা হচ্ছে সেটি জানতে চাইলে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। বিষয়টি নিয়ে শ্রমিকরা বাংলাদেশী দূতাবাসে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কোন কথাই বলেনা বলে তারা জানান।
করাচি জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কথা হয় ফেরৎ আসা আরেক বাংলাদেশী জহির হোসেনের সাথে। দেশে ছুটি কাটিয়ে চলতি বছরের শুরুতে আবার ওমানে গিয়ে কাজে যোগ দেন। দেশটির আল কুদ নামক এলাকায় রং মিস্ত্রির কাজ করতেন তিনি। কাজে যোগ দেয়ার কিছু দিন পরেই তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কেন আটক করা হলো জানতে চাইলে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয় বলে তিনি জানান।

জহির জানান, দীর্ঘ ২৮দিন জেলে থাকার পর এক কাপড়েই তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। জেল এর ভেতরে সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। বলেন, জেলের মধ্যে এমন খাবার দেয়া হয় যা খাবারের অনুপযোগী। এছাড়া খাবারে এমন মেডিসিন দেয়া থাকে যেগুলো খেলে শরীর দুর্বল করে ফেলে। কাজ ছাড়া সেখানে খাবার দেয়া হয়না। তিনি বলেন, জেলখানার বিভিন্ন দেয়ালে নিজেদের কষ্টের কথা লিখে রেখেছেন। যার সারমর্ম একটাই, ওমানে যেন আর কোনো বাংলাদেশীর এমন মানবেতর জীবনযাপন করতে না হয়। অনেকেই ওমানে না আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকার কথা জানতে চাইলে জহির জানান, এরা খুব খারাপ। এদের সাথে কোনো কথাই বলা যায়না। শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিনই বাংলাদেশীদের ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। দেশে এসে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে কিভাবে দিনাতিপাত করবেন সেটিই এখন ভাবছেন তিনি।

কথা হয় সুনামগঞ্জের আল আমিনের (২১) সাথে। অল্প বয়সেই পরিবারের ভার নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। এক মাস ২৩ দিন জেলে ছিলেন এই যুবক। দোকানের ভিসায় ওমানে নিয়ে খেজুর বাগানের কাজ করানো হতো তাকে দিয়ে। প্রতিবাদ করায় ঠিকানা হয় কারাগারে। তাকে কারাগার থেকে খালি পায়ে বিমানে তুলে দেয়া হয়। এ প্রতিবেদক তার পরিবারের বিস্তারিত জানতে চাইলে বলেন, ভাই-এসব লিখে কি হবে। যা হবার তো হয়ে গেছে। বিষয়গুলো কাউকে জানাতে চাইনা। কারণ জানিয়ে কোনো লাভ হবেনা।

পাকিস্তান এয়ারলাইন্সে করে দেশে ফেরত আসা ২৩ বাংলাদেশী জানান, ওমানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেখানে কারোরই কোনো নিরাপত্তা নেই। অধিকার বলতে কিছুই নেই। কাজের পারমিট আছে। তারপরও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বলা যাবেনা। ধরে নিয়ে তাদের লেবারকোর্টে উঠানো হয়। সেখান থেকে হয় জেলে অথবা বিমানে করে বাংলাদেশে। তারা জানান, অনেকে বিনা বেতনে কাজ করছে। মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে মানবেতর দিন কাটছে অনেক বাংলাদেশীর। কিছু বললেই চলছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।
সূত্র মতে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে ( ৬ মার্চ ২০১৮) বাংলাদেশী মোট শ্রম অভিবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ১৫ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭৮৯ জন। বিশ্বের প্রায় ১৬৫টি দেশে বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসীরা কাজ করছে। তবে আমাদের দেশের শ্রম অভিবাসীদের বড় অংশ প্রধানত ১১টি দেশে কর্মরত। এর ওমান অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে প্রতি বছর দুই লাখেরও বেশী শ্রমিক পাড়ি জমাচ্ছে। চলতি বছরের এই তিনমাসে দেশটিতে প্রায় ৩৫ হাজারের মতো বাংলাদেশী শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছে বলে জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, ওমানে থাকা এসব কর্মীর মধ্যে অনেকেই চুক্তি মোতাবেক ঠিকমতো বেতনভাতা পাচ্ছে না। কোনো কোনো কোম্পানিতে শ্রমিকদের ওপর চলছে মানসিক নির্যাতন। যার কারণে তাদের এখন দিন কাটছে অনেকটা মানবেতরভাবে। ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে শত কিলোমিটার দূরের মার্ককাট শহরের আলফা ওমান এলএলসি কন্সট্রাকশন কোম্পানির ভাড়া করা একটি বাড়িতে রাজশাহী উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে মকবুল হোসেন বাচ্চু, টাঙ্গাইলের গাজী মাজহারসহ ৫৭ শ্রমিকের দিন কাটছে মানবেতরভাবে। ইতোমধ্যে কোম্পানি থেকে তাদের বাড়িভাড়া পরিশোধ না করায় ওই বাড়ির মালিক বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এতে পানির তীব্র সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি কোম্পানির মালিককে জানানো হলেও তিনি বেতন সমস্যার দ্রুত সমাধানের কথা বলে সময় ক্ষেপণ করছেন। এ অবস্থায় তাদের থাকা ও খাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ওমান ফেরত বাংলাদেশীরা জানান, ওমানে চুক্তি মোতাবেক কাজ এবং বেতন কোনটাই দেয়া হচ্ছেনা। মকসুদ নামে এক শ্রমিক জানান, চুক্তি মোতাবেক ১২০ রিয়াল বেতন দেয়ার কথা থাকলেও মালিক শুরুতেই ২০ রিয়াল বেতন কম দিয়েছে। এক রিয়াল সমপরিমাণ ২০০ টাকা। পরে বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও সেটি আর মালিক বাড়ায়নি। এ অবস্থায় আমাদের কোম্পানিতে কাজ না থাকার দোহাই দিয়ে ছয়-সাত মাস ধরে ৫৭ জন শ্রমিকের বেতন ঠিকমতো দিচ্ছে না মালিক। তিনি বলেন, কয়েক মাসের পুরো বেতন আটকে রেখেছেন কোম্পানির মালিক খামিজ।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, গেল বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশটিতে শ্রমিক রফতানি হয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ৫৭২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৫ হাজার ৫৫৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ হাজার ৭৭৪, মার্চে ১৭ হাজার ৪৯, এপ্রিলে ১৭ হাজার ১৮২, মে মাসে ১৭ হাজার ৪৬৮ ও জুন মাসে ১৯ হাজার ২৯১ জন। আর চলতি মাসের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে সাত হাজার ২৫২ জন পাড়ি জমিয়েছে। এর পরের মাসগুলোতেও একই হাওে বাংলাদেশী শ্রমিক ওমানে পাড়ি জমিয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওমান ছাড়া আর কোনো দেশেই এত বিপুল পরিমাণ শ্রমিক পাড়ি জমায়নি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওমানে শ্রমিক যাওয়ার হার ২৭.৬৮।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ওমানগামী শ্রমিকদের নামে যেসব ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে সেগুলো দেয়ার আগে অবশ্যই বেতনভাতা ঠিক রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। একইসাথে যে কাজে তাদেও নেয়া হচ্ছে সেটি করানো হচ্ছে কিনা তাও দেখা প্রয়োজন। তারা বলছেন, সম্প্রতি ওমানে পাড়ি জমানো অনেকেই চুক্তি মোতাবেক বেতনভাতা পাচ্ছে না। কাজের পারমিট থাকা সত্ত্বেও তাদেও দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এগুলোর প্রতিবাদ জানানো উচিৎ। ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং করার আহ্বান জানান তারা। কারণ এমনিতেই মালয়েশিয়া, দুবাইসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু শ্রমবাজার এখনো বন্ধ রয়েছে। এই মুহূর্তে ওমানের বাজার হাতছাড়া হলে তখন জনশক্তি রফতানির গতি আরো কমে যাবে বলে তারা মনে করছেন। একইসাথে ওমানে যেতেও আগ্রহ কমে যাবে বলে মনে করেন তারা।

দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে উন্নত জীবনযাপনের স্বপ্ন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। যেসব কর্মী যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই দেশে থাকা সহায় সম্বলটুকু বিক্রি করে সেখানে যাচ্ছেন। অভাবগ্রস্ত, নিপীড়িত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এসব শ্রমিক বিদেশে গিয়ে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ভালো আচরণ, ভালো কাজ জানা সত্ত্বেও তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেককেই জেলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের নির্যাতনের কথা শুনে অনেকেই এখন বিদেশে যেতে আগ্রহী নন। ফেরত আসারা জানিয়েছেন শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্য়াতন চলে সেখানে। কর্মীর সঙ্গে নিয়োগকর্তারা ক্রীতদাসের মতোই আচরণ করেন। ঠিকমতো খাবার, সুপেয় পানি পর্যন্ত দেন না। চুক্তি অনুযায়ী বেতনও পান না তারা। ওমানের অনেক বাড়িতে বাংলাদেশী গৃহকর্মীরা বন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। ওমানের গৃহকর্তাদের দ্বারা বন্দী নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে ওই সব প্রতিবেদনে।

 

http://www.dailysangram.com/post/324944