২ এপ্রিল ২০১৮, সোমবার, ৯:৫৭

চিকিৎসাসেবা ও বৈষম্য

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি চিকিৎসাসেবার বেহাল দশার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অবকাঠামোগত সংকট, ওষুধ সংকট, চিকিৎসক ও জনবল সংকট, চিকিৎসাসেবার জন্য প্রয়োজন এমন যন্ত্রপাতির সংকট ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এ পর্যন্ত আলোচনা-পর্যালোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ কোনো কিছুই কম হয়নি বটে; কিন্তু এরপরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রা স্পর্শ করা যায়নি। সম্প্রতি পুনর্বার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে চিকিৎসকদের প্রতি গ্রামের মানুষকে সেবাদানের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। অতীতেও এমন আহ্বান জানানো হয়েছিল বটে; কিন্তু অদ্যাবধি এই সমস্যার সমাধান হয়নি বিধায় বিষয়টি নতুন করে পুনর্বার সামনে এসেছে। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখলাম, নেত্রকোনার মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯টি পদের বিপরীতে নয়জন চিকিৎসকের পদায়ন হয়েছে; কিন্তু কর্মস্থলে যাননি তাদের কেউই। একজন মেডিকেল অফিসার সামলাচ্ছেন ওই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এটি একটি খণ্ডিত চিত্র। এমন উপজেলা আমাদের দেশে আরও অনেক আছে, যেখানে এ ধরনের সংকট বিরাজ করছে।

সরকারি হিসাবেই ৬০ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। এর পাশাপাশি এমন চিত্র আমাদের দেশের উপজেলার হাসপাতালগুলোতে মোটেও বিরল নয় যে, একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চলছে একজন চিকিৎসক দিয়ে। এখানেই শেষ নয়, কোনো কোনো উপজেলায় বাই-রোটেশনে চিকিৎসকরা হাজিরা দিয়ে চলেছেন। বিস্ময়কর হলো যে, প্রত্যন্ত এলাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সংকট প্রকট হলেও এর বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে শহরের হাসপাতালগুলোতে। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখলাম, রাজধানীর চারটি হাসপাতালে ১৪০ জন চিকিৎসক এখনও ওএসডি পোস্টিং নিয়ে অবস্থান করছেন। অন্যান্য বড় শহরের চিত্রও এ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নিকট অতীতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকাসহ সারাদেশে কোনো হাসপাতালে সংযুক্তি পদায়ন থাকবে না। কর্মস্থলে অনুপস্থিত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও সরকার অবস্থান গ্রহণ করবে। ভালো কথা। কিন্তু 'হবে', 'হচ্ছে'র জটাজালে যেন আমাদের এখানে প্রয়োজনীয় কাজগুলো বৃত্তবন্দি হয়ে থাকার এক ধরনের অপসংস্কৃতি ক্রম পুষ্ট হয়ে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার সরকারি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, এটি প্রশ্নের বিষয়। প্রধানমন্ত্রী তো এমন কথাও বলেছেন যে, উপজেলায় থাকতে না চাইলে চিকিৎসকরা চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও পরিস্থিতির কি কোনো উন্নতি হয়েছে?

সরকার প্রধানের এমন কথার পরও সরকারের ক্ষমতাবান কেউ কেউ চিকিৎসকদের তদবির বাস্তবায়নে অধিকতর সক্রিয় রয়েছেন এবং এতে তারা নিজেদের লাভালাভের অঙ্ক কষছেন এমন অভিযোগও শোনা যায়। যদি এই হয় অবস্থা, তাহলে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগেরই সঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি এও বলেছেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলকভাবে তিন বছর উপজেলায় থাকতে হবে। এসবই আশাব্যঞ্জক কথা। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসবের ইতিবাচক প্রতিফলন আমরা কতটা কী দেখছি বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যেই এর উত্তর নিহীত রয়েছে। জনস্বাস্থ্য সংশ্নিষ্ট এ বিষয়ে অবশ্যই দ্রুত কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এসব বাস্তবায়নে দৃঢ় হতে হবে। সর্বাগ্রে জরুরি হলো এ জন্য দ্রুত একটি পৃথক তদারকি সংস্থা কিংবা কমিশন গঠন করা। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সবকিছু দেখভাল করবে এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো যাতে যথাযথভাবে সম্পাদন হয় সেক্ষেত্রে নির্মোহ দৃষ্টি রাখবে। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা চিত্র অতীতের চেয়ে এখন অনেকটাই ভালো। বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ছে এবং শিশু ও প্রসূতি মৃত্যু কমছে। কিন্তু তারপরও এ ক্ষেত্রে সরকারের যে বিনিয়োগ কিংবা প্রচেষ্টা সেই অনুপাতে সুফল মেলেনি কিংবা মিলছে না। কেন ঢাকার বাইরে চিকিৎসকরা অনুপস্থিত থাকেন এর কোনো সদুত্তর মিলছে না। এখন তো অবকাঠামোগত সমস্যাও আগের চেয়ে অনেক ভালো। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গেও যোগাযোগ মাধ্যম অনেকটাই মসৃণ। তাছাড়া অন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি মফস্বলে থাকতে পারেন, তাহলে চিকিৎসকরা পারবেন না কেন? এ ক্ষেত্রে পৃথক তদারকি সংস্থার কেন প্রয়োজন রয়েছে, এ বিষয়টি দ্রুত গুরুত্ব দিয়ে ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন মনে করি। এই তদারকি সংস্থার যেন আবার তদারকি করতে না হয় সে রকম ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে।

একজন চিকিৎসকের সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত। অন্যদের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের বিষয়টি মেলালে চলবে না। চিকিৎসা সুবিধা মানুষের অগ্রাধিকার। মনে রাখতে হবে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষরা। তাদের নগর-মহানগরে এসে আধুনিক বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের ছড়াছড়ি এখন মফস্বল শহরেও রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালন না করে অনেক চিকিৎসক এসব ক্লিনিকে যুক্ত থেকে নিজেদের পকেট স্ম্ফীত করছেন, এমন সংবাদও নতুন কিছু নয়। তবে এ কথাও সত্য যে, এর বাইরেও চিকিৎসক আছেন। যারা মানবতাকে শীর্ষস্থান দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের সংখ্যা কত?

'ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল' এক সময় এমন কথা প্রবাদের মতো আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। এখন অবস্থা ঠিক সে রকম নেই সত্য। কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে চিকিৎসকদের একটি অংশের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অবহেলা। হাসপাতালের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে জরুরি বিভাগ। অথচ সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাসপাতালগুলোর মধ্যে কতগুলোতে জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাকরি করে অনেক চিকিৎসক বেসরকারি চিকিৎসালয়ের তথা সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করেন। আবার সেখানেও অনেক চিকিৎসক চিকিৎসাকে সেবা খাত হিসেবে না দেখে একান্তই বাণিজ্যিক খাত হিসেবে মূল্যায়ন করেন। এমনও দেখা যায়, কোথাও কোথাও মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত অর্থ আদায় না হওয়ার কারণে। চিকিৎসা লাভে ইচ্ছুক কোনো ব্যক্তির প্রতি অমানবিক আচরণও করা হয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন চিকিৎসকদের দায়িত্ব সচেতনতার অভাব দূর করতে হলে তাদের অবশ্যই আনতে হবে জবাবদিহিতার আওতায়। সরকারি চিকিৎসকদের মধ্যে গ্রামে না যাওয়ার যে প্রবণতা তা দূর করতেও দরকার তদারকি সংস্থার।

চিকিৎসাসেবাকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে সরিয়ে আনার মতো দুরূহ কাজটি যদি করা যায়, তাহলে আমাদের চিকিৎসাসেবার মান অনেকাংশ বেড়ে যাবে। চিকিৎসা খাতের বহুবিধ দুরবস্থার কারণেই একটু সামর্থ্যবান মানুষ সাধারণ চিকিৎসার জন্যও বিদেশ চলে যান। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে তা অসম্ভব। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা ভাবতে হবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কঠিন অবস্থান নিয়ে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য দেশের সব হাসপাতালের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রত্যেকে যথাযথ চিকিৎসাসেবা পান। মানুষের এই মৌলিক অধিকার ভোগ করার যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ওপরের স্তরের দায়িত্বশীলদের শুধু কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে যে, তদবিরের জাল ছিন্ন করে মানুষের অধিকারের ব্যাপারে কোনো আপস নেই।

তদবির আমাদের সমাজ বাস্তবতায় এক ধরনের ব্যাধি। এই ব্যাধি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্যসেবাকে আধুনিক করার সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে এ বিভাগকে ঢেলে সাজাতে হবে। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা-দুর্নীতির শিকড় উৎপাটন করতে হবে। তা না হলে সরকারকে যেমন ব্যর্থতার দায় বহন করতে হবে, তেমনি মানুষও যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে। দায়িত্বশীলদের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি-দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হতে হবে কঠোর ও নির্মোহ। কত সংখ্যক চিকিৎসক প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ছুটি ভোগ করবেন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক রাখার জন্য কত সংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন হবে- এসব ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। একই সঙ্গে কী কী কারণে চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে চান না, তা তাদের কাছ থেকে জানতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় বসা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, জনবল, চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য-উপাত্ত, সেবাদানের সঠিক নির্দেশিকা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। এসব উপাদানের যে কোনো একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

একই সঙ্গে আরও একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তা হলো, গ্রাম ও শহরের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। বৈষম্যের নিরসন ঘটাতে হবে। শহর ও গ্রামে চিকিৎসকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালাও প্রয়োজন। কেউ বছরের পর বছর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে থাকবেন আর কেউ নগর-মহানগরে কিংবা এর আশপাশে থাকবেন, তা তো হতে পারে না। সব ক্ষেত্রে দরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।

অর্থনীতিবিদ

http://samakal.com/todays-print-edition/tp-muktomoncha/article/1804292