রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এভাবে পানির জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ছবিটি উত্তর বাড্ডার সাতারকুল এলাকা থেকে নেয়া
৩১ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ৮:২০

রাজধানীতে পানির তীব্র সংকট

শাহিনা আক্তার ডলি। থাকেন রাজধানীর মাতুয়াইল মেডিকেল এলাকায়। দিনের পাশাপাশি রাতের বেশীরভাগ সময়ও তাকে জেগে থাকতে হয়। জেগে থাকাটা শুধুই একটু পানির আশায়। তিনি জানান, মাতুয়াইল মেডিকেল এলাকায় দিনের বেলায় ওয়াসার পানি আসেনা। রাত ২টার পর একটু একটু পানি আসে। রাতে যেটুকু পানি আসে তা সংগ্রহে রেখেই পরের দিনের সব কাজ করতে হয়। পানি স্বল্পতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাতভর অপেক্ষা করে যেটুকু পানি পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনো রকমে রান্নার কাজ করা যায়। ওজু-গোসল করাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বারবার সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো উন্নতি ঘটছেনা বলে জানান তিনি।

প্রতিবারের মতো এবারও গ্রীষ্ম শুরু হতে না হতেই মাতুয়াইলের ন্যায় রাজধানীর অনেক এলাকায় পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। চারদিকে পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা গত কয়েকদিন ধরে ভুগছে পানির কষ্টে। তাদের অভিযোগ, এ্খনো সেভাবে গরম শুরু হয়নি। তার আগেই পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। মাস খানেক পরে কি হবে তা এখনই তা এখই টের পাওয়া যাচ্ছে।

সূত্র মতে, রাজধানী ঢাকায় প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের বসবাস। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়ছেনা ওয়াসার কার্যক্রম। তারা তাদের স্বাভাবিক কাজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে এই শহরে বিশুদ্ধ পানি পাওয়াটা দুষ্কর হয়ে পড়ছে। রাজধানীতে পানির সংকট নতুন কোনো বিষয় না হলেও গরমের শুরুতেই এমন সংকট ভাবিয়ে তুলেছে নাগরিকদের। ওয়াসা বলে, পানি উৎপাদনে ঘাটতি নেই, তবুও পানির সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই পানির জন্য মিছিল হচ্ছে। প্রতিবাদ হচ্ছে। এছাড়া আর যেসব এলাকায় পানির সংকট নেই, সেখানকার পানিও ময়লা-দুর্গন্ধের কারণে খাবারের অযোগ্য। এমতাবস্থায় চলতি গ্রীষ্ম মওসুমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ওয়াসার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পানি সংকটে একমাস ধরে ভুগছে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার সাতারকুল রোডের এলাকাবাসী। তাদেরকে রীতিমতো ছোটাছুটি করে লাইনে দাঁড়িয়ে অন্যের বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য অত্যন্ত ক্ষোভ প্রকাশ করছে এলাকাবাসী। স্থানীয় এক নারী বলেন, লাইনে অনেকদিন ধরেই পানি নাই। পানি টানতে টানতে আমরা অসুস্থ হয়ে গেছি। আমরা রান্না করবো সেই পানিও পাচ্ছি না ঠিক মতো। আরেকজন স্থানীয় বলেন, আমরা কারওয়ান বাজরের হেড অফিসে অ্যাপ্লিকেশন করেছি। তারা বলছে রাস্তার লাইন উঁচু। এইজন্য পাইপের লাইনও উঁচু আছে।
একই অবস্থা মতিঝিলের আরামবাগে। আর মনিপুরের কাঠালপাড়াবাসী একদিন পর পর রাতে পানি পাচ্ছেন। তাদের এই অবস্থা চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। দুর্গন্ধ ময়লাযুক্ত পানি সরবরাহ হচ্ছে মগবাজার, মিরপুর, গেন্ডারিয়া ও ধোলাইখালে। এছাড়া পানির কষ্ট রয়েছে আগারগাঁও, খিলগাঁও, মান্ডা, পূর্ব জুরাইন ও পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারের এলাকাবাসীরা।

গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা ফজলুর রহমান জানান, আমাদের এই এলাকার পানিতে অনেক দিন ধরেই দুর্গন্ধ এবং পানির রং হলুদ। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। আরামবাগের এক নারী জানান, এক সপ্তাহ ধরে আমাদের পানি নেই। আমরা অনেক কষ্ট করছি। গোসল করতে পারিনা এবং কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারি না।
বছরের প্রায় সময়েই রাজধানীর কোথাও না কোথাও পানি সংকট লেগেই আছে। সেটি আরও তীব্র হয় গরমকালে। তবে সেটি এবার আগেই দেখা দিয়েছে। রাজধানীর প্রায় অর্ধেক এলাকাজুড়ে পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে মূল রাজধানীর বাইরের অংশের অবস্থা বেশী খারাপ। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনে যুক্ত হওয়া নতুন এলকাগুলোতে পানি সংকট সবচেয়ে বেশী। এখানে ঢাকা ওয়াসা সেভাবে পানি সমস্যা সমাধানে কাজ করছেনা। অভিযোগ করলেও তারা বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়না বলে এলাকাবাসীরা জানান।

ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা প্রতিদিন ২৪৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করতে সক্ষম। আর বর্তমানে ২৪০ কোটি লিটার পানির চাহিদা রয়েছে রাজধানীতে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনও হচ্ছে। সেই অনুযায়ী রাজধানীতে পানি সংকট থাকার কথা না। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। তবে ওয়াসা তাদেও উৎপাদনের পরিমাণটা জানালেও সিস্টেম লসের বিষয়টি সেভাবে প্রকাশ করতে চায়না। হিসেব মতে, উৎপাদিত পানির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পানি সিস্টেম লসে চলে যায়। যার প্রভাব পড়ে রাজধানী জুড়ে।

সম্প্রতি ওয়াসা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতেও পানি সংকটের কারণে গ্রাহকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে ঢাকা শহরে পানি সংকট রয়েছে, এ কথা অস্বীকার করেছেন ওয়াসার কর্মকর্তারা। অবশ্য তারা পানিতে ময়লা-দুর্গন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, ওয়াসার পানির অনেক চোরাই সংযোগ রয়েছে, অবৈধ সংযোগ করতে গিয়ে লাইনে ছিদ্র হয়ে যায়, সেই ছিদ্র দিয়েই পানিতে ময়লা ঢুকে গন্ধ ছড়াতে পারে। এছাড়া নদীর পানিতে খুব বেশি পরিমাণ ময়লা আবর্জনা থাকে, সেই পানি রিফাইনিং করে বিশুদ্ধ করতে প্রচুর কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়। একারণেও দুর্গন্ধ হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর অনেক এলাকায় পুরনো পানির লাইন তুলে সেখানে নতুন লাইন বসানো হয়েছে। কিন্তু পুরনো লাইনগুলো তুলে না ফেলায় সেগুলো দিয়ে এখনো পানি সরবরাহ হচ্ছে। ফলে এসব পানিতে দুর্গন্ধ বেশী হচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ওয়াসার প্রায় পৌনে ৪ লাখেরও বেশি গ্রাহক সংযোগ রয়েছে। তবে একটি বাড়িতে একটি সংযোগ থাকলেও সেখানে একাধিক পরিবার বাস করছে। ফলে বাস্তবে গ্রাহকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এছাড়া প্রচুর অবৈধ সংযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর পূর্ব রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে পানি মিলছে না। হঠাৎ মাঝে মধ্যে একবার পানি দেওয়া হয়। মগবাজার এলাকায় দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য পানি আসে। পরবর্তীতে সারা দিনই দেখা মেলে না পানির। একই অবস্থা রাজধানীর জোয়ার সাহারা, কালাচাঁদপুর, নতুন বাজার, বাউনিয়া বাঁধ, উত্তর ইব্রাহিমপুর, মিরপুর-১০, পীরেরবাগ, বড়বাগ, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, আরামবাগ, মানিকনগর, কালাপানি, কালশী, পশ্চিম মনিপুর, মুরাদপুর, কেদার নাথ দে লেন, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডাসহ অনেক এলাকার। মাসের পর মাস দিনে একবার পানি দেওয়া হয় এসব এলাকায়। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ড জুড়ে গত কয়েক মাস ধরে বিরাজ করছে পানি সমস্যা। কিছু দিন আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২২ জন কাউন্সিলর ওয়াসার এমডিকে পানি সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ওইসব এলাকার ৯০ ভাগ বাসিন্দাই নিরাপদ পানি পান না।

বড়বাগ এলাকার পপুলার হাউজিংয়ের বাসিন্দা মিজান বলেন, গত দেড় মাস ধরে এই সমস্যা চলছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। পূর্ব রামপুরা এলাকার বাসিন্দা সমীরণ জানান, এক সপ্তাহ যাবতৎ পানি নেই পূর্ব রামপুরা এলাকায়। একবার পানি দিলেও সেই পানি দিয়ে কোনো কিছুই ভালো ভাবে করা যায় না। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের রিপোর্টার ফারজানা আক্তার ফেসবুকে লিখেছেন, গরম আসতে না আসতেই ঢাকায় শুরু হয়েছে ওয়াসার পানি সংকট। মগবাজার এলাকায় দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য পানি দেওয়া হচ্ছে।

ওয়াসা নিয়ে গত ১৪ মার্চ মিরপুরের বিআইবিএম মিলনায়তনে দুদকের গণশুনানিতে মিরপুরের বড়বাগ এলাকার নজরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এলাকার কিছু অংশকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। ১০ বছর ধরে আমরা পানির জন্য কষ্ট করছি কিন্তু পানি পাই না। এই পানির জন্য ঘুরতে ঘুরতে পায়ের জুতা কয়েক জোড়া ক্ষয় করেছি কিন্তু সমাধান পাইনি। উত্তর ইব্রাহিমপুরের শহিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দিনের পর দিন যায় কিন্তু ঠিকমতো ওয়াসার পানি পাওয়া যায় না। পানির জন্য বারবার ওয়াসা কার্যালয়ে গেলেও কোনো লাভ হয় না।’ এই গণশুনানিতে ওয়াসার বিরুদ্ধে সবগুলোই পানি না পাওয়ার অভিযোগ। এ প্রসঙ্গে ওয়াসার কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেন, বড়বাগসহ আশপাশের এলাকা অনেক জনবহুল। সেখানে চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ কম।

গণশুনানির শেষ পর্যায়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান পানি সমস্যা নিরসনে ওয়াসার নানা কর্মকা-ের কথা তুলে ধরে গ্রাহকের ভোগান্তি ও হয়রানি কমাতে গোটা ওয়াসার কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানান।
এদিকে জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ ও নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পিওরইট ও এসডিআই যৌথভাবে পরিচালনা করছে মাইক্রোফাইন্যান্স কার্যক্রম। এর ফলে নাগরিকদের বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির চাহিদা মিটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এসডিআইর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হক বলেন, নিরাপদ পানির জন্য এটা একটি অভিনব উদ্যোগ। যা গ্রামাঞ্চলসহ সকল মানুষের জীবনকে আরো স্বাস্থ্যকর করে তুলবে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে যে কেউ সুবিধাজনক মাসিক কিস্তিতে পিওরইট ডিভাইস কেনার সুযোগ পাবেন বলে তিনি জানান।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ৭৮০ টি পাম্প থেকে আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড পানি এক্সট্র্যাক্ট করি। হরহামেশাই একটা দুটো পাম্প যখন খারাপ থাকে, তখন ওই এলাকায় সামান্য একটু সমস্যা হয়। আমরা এটাকে বলছি পকেট সমস্যা। আমাদের সামগ্রিক উৎপাদন প্রতিদিনই টোটাল ডিমান্ডের চেয়ে বেশি। সিস্টেম লসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি তো হয়েই থাকে। তিনি জানান, গ্রীষ্ম মওসুমকে সামনে রেখে ওয়াসার বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। কোথাও পানি সমস্যা থাকলে সেখানে সরবরাহ করা হবে।
ঢাকা ওয়াসার সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, ব্যালেন্স নেটওয়ার্কের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে এখানে সিস্টেম ডিজাইনই অন্যরকম। সেটা হলো যে একটা মাদার পাইপলাইন থাকবে। যাতে করে কোনো সমস্যা হলে সেই পাইপ থেকে পানি অন্যখানে ট্রান্সফার করা যায়। তিনি বলেন, এটা সত্য যে, রাজধানীতে প্রতিদিন যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে সেভাবে পানি সরবরাহ নিশ্চিৎ করা যাচ্ছেনা।

http://www.dailysangram.com/post/324667