২৭ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৫৪

জনগণের আমানত ঋণের নামে লুটপাট

নথি নেই, ঋণের আবেদন নেই, নেই কোনো স্বাক্ষরও; জামানত তো দূরের কথা। তবু হলমার্ককে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। আর এতেই ঘটে গেছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি। বেসিক ব্যাংক গত কয়েক বছরে কোন প্রতিষ্ঠানকে কত টাকা দিয়েছে, তার হিসাব নেই খোদ ব্যাংকের কাছেই এবং যথারীতি ঘটে গেছে সেই টাকা লুটপাটের ‘উৎসব’। এভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠান, ভুয়া নথিপত্র দেখিয়ে অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণের নামে জনগণের আমানত লুটেপুটে নিচ্ছে ব্যাংক থেকে। কারখানা নেই, অফিস নেই, বন্ধকি জমিও নিজের নয়, এমন অনেক গ্রাহকের ঋণ আবেদনও মঞ্জুর করছে ব্যাংক। সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণের নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; এমনকি কবরস্থানের জমি বন্ধক রেখেও ব্যাংক থেকে অর্থ নিতে পারছে তারা। পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই প্রাপ্য টাকার দ্বিগুণ-তিন গুণ ঋণ দিয়ে দিচ্ছে ব্যাংক। আবার শুধু নিজে ঋণ দিয়ে খেলাপি হওয়াই নয়, গ্রাহক বানানোর জন্য অন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পর্যন্ত কিনে নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। প্রভাবশালী লুটেরাচক্র একটু বেকায়দা দেখলেই আইন-আদালতের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে বহাল তবিয়তে, কখনো কখনো দ্বিগুণ উৎসাহে লুটপাটে লিপ্ত হয়। এভাবে ব্যাংকঋণ লেনদেনের নামে টাকা লুটপাটকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশ।

অন্যদিকে জালিয়াত গ্রাহকদের প্রতি ব্যাংকগুলোর বিশেষ প্রীতি থাকলেও নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণের জন্য ঘুরতে হয় দ্বারে দ্বারে। উপযুক্ত জামানতের নথি নিয়ে ঘুরলেও প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান নিশ্চিত হয় না তাদের। দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি শিল্প গ্রুপকে দেশে বৃহত্তম জ্বালানি তেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা করতে ছয় হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে হচ্ছে ২৪টি ব্যাংক থেকে। এই রিফাইনারিতে উৎপাদিত পণ্য কিনবে সরকার, ফলে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার শতভাগ নিশ্চয়তা রয়েছে; তা সত্ত্বেও ঋণ পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে ওই কম্পানিকে।

অথচ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে ব্যাংক। ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হলে দেশের সমৃদ্ধি-উন্নয়নও মুখ থুবড়ে পড়বে। এ দেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ—স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের চূড়ান্ত স্বীকৃতি অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতেও ব্যাংক খাতকে মজবুত রাখা অতি জরুরি। অথচ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বাস্তবে ব্যাংক সুরক্ষার শক্ত ব্যবস্থা দেশে নেই—না আইনে, না ব্যবস্থাপনা-পরিচালনায়। উল্টো পাকাপোক্তভাবে আছে ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের টাকা লুটপাট করে ব্যাংক ফাঁকা করে দেওয়ার ‘সুব্যবস্থা’।
গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণের জামানতের কাগজপত্র ভুয়া জেনেও রাজনৈতিক চাপে কিংবা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংকগুলো ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে দিচ্ছে, ঋণের এসব টাকা কোনো দিন ফেরত পাওয়া যাবে না জানার পরও। মাত্র ছয় বছরে এ্যাননটেক্স নামের একটি গ্রুপকে জনতা ব্যাংক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে পাঁচ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছে নির্বিঘ্নে। সোনালী ব্যাংক হলমার্ককে যে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা দিয়েছে, তার বেশির ভাগ ঋণের কোনো আবেদনপত্রও ছিল না। কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে আবেদনপত্র থাকলেও তাতে হলমার্কের এমডি তানভীর আহমেদের কোনো সই-স্বাক্ষরও ছিল না। তবু প্রতি রাতে মাইক্রোবাস ভরে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে টাকার বস্তা চলে যেত হলমার্কের অফিসে। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় কাকে, কত টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে তার কোনো হিসাব এখন পর্যন্ত নেই ব্যাংকটির কাছে।

কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই নয়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলছে। এসব ঋণ জালিয়াতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ছেন ব্যাংকের পরিচালক ও মালিকরা। ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির মালিকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাঁরা কমিশন নিয়ে, ঘুষ নিয়ে জনগণের আমানতের টাকা ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন, নিজেরাও তুলে নিয়েছেন। এমনকি ব্যাংক রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও ব্যাংকের ভক্ষক হয়ে উঠেছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও নীলফামারী-৪ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি শওকত চৌধুরী একই জমি বন্ধক রেখে দুটি ব্যাংক—বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। নিজের তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে কমার্স ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে নিয়েছেন ৯৩ কোটি টাকারও বেশি। ঋণ জালিয়াতির দায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন ঢাকার হাজারীবাগের নর্থ ইস্ট ট্যানারির ৪৫ শতাংশ জমি বন্ধক রেখে অগ্রণী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রোমভেজ ট্যানারি লিমিটেড। কিন্তু ঋণের একটি টাকাও পরিশোধ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলার বিজ্ঞাপন দিয়েছে সংবাদপত্রে। ওই বিজ্ঞাপন দেখার পর বিস্মিত শিল্প মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখে বলেছে সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে দুই দফা চিঠি দেওয়ার পরও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আইন-আদালতের ফাঁক গলে... : ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বেশির ভাগ ঋণই আর আদায় হয় না। আবার কোনো কোনো খেলাপি গ্রাহক উল্টো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দেন, যাতে তাঁকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে ব্যাংক। বড় আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য খেলাপিমুক্ত থাকার আদেশ বের করে আনেন আদালত থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) কর্মকর্তারা জানান, কোনো কোনো খেলাপি গ্রাহককে নিয়ে দুদক যাতে তদন্ত না করে এমন বিষয় উল্লেখ করেও আদালত থেকে রায় নিয়ে আসে কোনো কোনো ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান। ফলে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নতুন করে আরো ঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়, ঋণের টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপির তকমা থেকে রেহাই পায়। এ ধরনের অনেক খেলাপি গ্রাহক বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকও থাকেন।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক ছিলেন আবদুল আউয়াল পাটোয়ারি। তাঁর প্রতিষ্ঠান পাটোয়ারি পটেটো ফ্লেক্স লিমিটেডের কাছে অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ছিল প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক পেত ৩০ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ না করায় এসব ব্যাংকে খেলাপি হন তিনি। খেলাপি চিহ্নিত হলে ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারবেন না। তাই উচ্চ আদালতে রিট করে গত বছরের শেষ দিকে নিজের পক্ষে রায় নিয়ে আসেন তিনি। বর্তমানে তাঁর পরিচালক পদ নেই।
একজন-দুজন নয়, উচ্চ আদালতে এভাবে রিট করে ৬০০ খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ ধরনের রায় নিয়ে এসেছে বলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির। তিনি বলেছেন, ‘ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ঋণখেলাপি প্রদর্শনের পরও কোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এ রকম প্রায় ৬০০টি মামলা আছে, যেখানে ঋণখেলাপি স্ট্যাটাস প্রদর্শন বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।’
গভর্নর বলেন, আদালতের রায়ের ফলে খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে দেখানো যায় না। আর খেলাপি না দেখানো হলে ওই গ্রাহকের একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না। ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে একাধিক ব্যাংক থেকে যখন আরো বেশি ঋণ নিচ্ছে, তখন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণের জন্য ঘুরছেন ব্যাংকের দরজায় দরজায়। উচ্চ আদালতের এসব রিট বছরের পর বছর ধরে চলে, নিষ্পত্তি হয় না। ঋণখেলাপিরাই প্রভাব খাটিয়ে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হতে দেয় না। আর যত দিন মামলা নিষ্পত্তি না হয়, তত দিন অর্থ পরিশোধের কোনো ঝামেলাও নেই। বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোর তরফ থেকে উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠনের দাবি উঠলেও, তা হচ্ছে না। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেও পৃথক বেঞ্চ গঠন করাতে পারেননি।
অর্থঋণ আদালতে মামলায় দীর্ঘসূত্রতা : বাংলাদেশে অর্থঋণ আদালত আইনের আওতায় মামলা করে আদালতের নির্দেশে তার বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রি করে ব্যাংক অর্থ আদায় করে। তবে অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘতর প্রক্রিয়া। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে প্রায় দুই লাখ। এসব মামলায় জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। তবে অবলোপন করা ঋণ, গত ডিসেম্বরে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা ঋণের হিসাব আমলে নিলে এর পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকারও অনেক বেশি হবে।

ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অনেক ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালত থেকে মামলার ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে থাকে। আবার অর্থঋণ আদালতের রায়ে বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক নিলামে তুললে তার ওপরও স্থগিতাদেশ পাওয়া যায় উচ্চ আদালত থেকে। সোনালী ব্যাংক হলমার্কের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর বাকিগুলোর নিলাম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হলেও তাতে কেউ অংশগ্রহণ করে না। হলমার্কের কয়েকটি কারখানা নিলামে তুলেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। ফেনীর সোনা ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন রূপালী ব্যাংক থেকে ৯৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না। ব্যাংক টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করে আনোয়ার হোসেনের একটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান নিলামে তোলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া বিজ্ঞপ্তির মেয়াদ ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, কিন্তু কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি।

লুটেরা রক্ষার ‘সুব্যবস্থা’... : বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পরিশোধ না করে পার পাওয়া যায় সহজে। আদালত থেকে রায় নিয়ে খেলাপিরা আবারও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ নিতে পারে। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা ও পর্ষদের সদস্যরা যত সহজে ঋণের নামে আমানতের টাকা অসৎ ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন, তা আদায়ে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ চেষ্টাও থাকে না। খেলাপি ও ব্যাংক লুটপাটকারীদের জন্য এত উদার ব্যবস্থা আর কোনো দেশে নেই। ভারতে কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের আয়ত্ত নেওয়ার চেষ্টা করে। সে ক্ষেত্রে ভারতে ব্যালান্সশিট বেসড ব্যবসা বিদ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের কম্পানিগুলোতে এ ধরনের করপোরেট সংস্কৃতি নেই। যখন বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের আর কোনো ঋণসীমা থাকে না, সব ক্ষেত্রেই যখন তারা খেলাপি হয়, তখন মালিকানায় থাকা ব্যক্তিরা আর অর্থ পায় না। কিন্তু ওই সব খেলাপি লোকের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। নেপালে কোনো ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হওয়ার ভয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার প্রবণতা দেশটিতে কম। সেখানে খেলাপি ঋণের হার ২ শতাংশেরও কম।

নিলামে দরদাতা না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথমত যে সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়, তার গুরুত্বের ওপর এটি নির্ভর করে। আবার অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে নিলামে তোলা হয় বেশির ভাগ সম্পত্তি। সে ক্ষেত্রে মানুষ মনে করে, আদালতের মাধ্যমে টাকা দিয়ে জমি বা সম্পদ কিনলে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা বুঝে পাওয়া যাবে না। আবার আদালতের মাধ্যমে জমি কিনলে প্রকৃত দর মেনে তাকে কোর্ট ফি, রেজিস্ট্রেশন খরচসহ সব ধরনের খরচ বহন করতে হয়। তখন টাকার উৎস দেখানো নিয়েও চিন্তায় পড়তে হয়। সাধারণভাবে জমি কিনলে এসব খরচ অনেক কম দেখানো যায়। তবে ব্যাংক আদালতের মাধ্যম ছাড়া সরাসরিও নিলামে তুলতে পারে। তাতে সময় লাগে না। কিন্তু বাড়তি খরচ ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতার রোষানলে পড়ার ভয়েও অনেকে তাতে আগ্রহী হন না।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায় পরিস্থিতিতে হতাশ অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বিভিন্ন ফোরামে খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ বিদেশে খেলাপি হলে ওই প্রতিষ্ঠানের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন অন্যরা সতর্ক হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ‘বেল আউট’ দিয়েও টাকা আদায় করছে। আমাদের দেশে কোনো টাকা আদায় হচ্ছে না।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকতে হবে। না হলে খেলাপির সংস্কৃতি কমবে না। এ জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। খেলাপি ঋণ বাড়লে ভালো গ্রাহকদের ভোগান্তি বাড়ে। খেলাপি যত বাড়ে ব্যাংক ভালো গ্রাহকদের ওপরে সুদহার তত বাড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ডিউ ডিলিজেন্স না করার কারণে খেলাপি বাড়ছে। উদ্যোক্তারা কেমন, এদের ট্র্যাক রেকর্ড কী, সেসব তথ্য সঠিকভাবে খতিয়ে দেখছে না ব্যাংকগুলো। এদের অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে কারণে খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েই চলেছে। ব্যাংকগুলোর উচিত ভালো আইনজীবী দিয়ে এদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা পরিচালনা করা।’
বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান আকরাম উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকার সময় উচ্চ আদালতে থাকা রিট মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য কতবার বলেছি একটা পৃথক বেঞ্চ করে সহযোগিতা করুন। তাও হয়নি।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকের এজিএম অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ব্যাংকখাতে বিতরণ করা ঋণের ১১ শতাংশের মতো এখন খেলাপি হয়ে গেছে, যেগুলো আদায়ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে আমার মনে হয়, সরকারও কিছুটা দায়ী।’ খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আইনের পাশাপাশি দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭-এর আওতায় খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন তিনি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/03/27/618056