২৭ মার্চ ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩৮

কোটিপতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য

দেশের ব্যাংকিং খাতে কোটি টাকার আমানতকারী হিসাব সংখ্যা বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে এসব হিসাবে জমানো অর্থের পরিমাণও। কোটিপতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যও। উন্নয় জাতি গঠনের যে লক্ষ্য রয়েছে তা বাস্তবায়নে এই বৈষম্য কমাতে হবে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোটি টাকার আমানতকারী বেড়েছে ৫ হাজার ৮৩৪ জন। বর্তমানে মোট কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৬৭ হাজার ৮৭২ জন। যা এক বছর আগে ছিল ৬২ হাজার ৩৮ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্য নিয়ে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কোটিপতি আমানতকারী বাড়লে কিছুটা অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায়। মূলত বিনিয়োগ করতে না পেরে সবাই আমানতমুখী হচ্ছে। তবে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই এই অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এতে অর্থনীতির আকার বাড়বে।
জানা গেছে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা যেহারে বাড়ছে সে হারে রাজস্ব বাড়ছে না। এতে করে কালো টাকার পরিমাণ বাড়ছেই। এনিয়ে অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলেও প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে নানা সময়ে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি।

অর্থনীতির পরিধি বাড়ছে তার সাথে বেড়েছে অর্থ পাচারও। পণ্য আমদানির নামে প্রতিনিয়তই অর্থ পাচার হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি এনবিআর। পাচার এতই বেড়েছে যে সিপিডিসহ অর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাতেও থেমে নেই অর্থ পাচার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৮৭২ জন। যা ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ছিল ৬২ হাজার ৩৮ জন। সেই হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৫ হাজার ৮৩৪ জন কোটিপতি আমানতকারী।
তবে ২০১৭ সালের জুনের শেষে এই সংখ্যা ছিল ৬৮ হাজার ৮৯১ জন। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে সেপ্টেম্বরে তা কমেছে ১ হাজার ১৯ জন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি ছিল ৭০২ জন। ২০১৭ সালের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫২ জন।

গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকা আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ৫৩ হাজার ৩৪৪ জন। যা ২০১৬ সালের একই সময়ে ছিল ৪৮ হাজার ৮৯৭ জন। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ৫৩ হাজার ৩৪৪ জন। যা তিন মাস আগে ছিল ৫৪ হাজার ৩১৭ জন।
সেপ্টেম্বরে শেষে ৪০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন, এমন ব্যক্তি রয়েছেন ৪১৫ জন। ৩৫ কোটি টাকারও বেশি আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ১৯৬ জন। ৩০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ২৭২ জন। ২৫ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ৪৬৯ জন। ২০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ৭৯৯ জন। ১৫ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন এক হাজার ২৯৬ জন। ১০ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ২ হাজার ৫২৪ জন। ৩ কোটি টাকারও বেশি আমানত রেখেছেন ৭ হাজার ৭০৫ জন।
দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো না থাকার কারণে ব্যাংকে কোটিপতিদের আমানত বাড়ছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন,ব্যাংকে আমানত বাড়লে সে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। এতে করে দেশের বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। উন্নত দেশ হবার যে টার্গেট আমাদের রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তা না হলে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

জাতীয় উৎপাদনে আনুপাতিক হারে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ খুবই কম উল্লেখ করে মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত ৮/১০ বছর ধরে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। ২০০৮-৯ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৮/৯ বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহী নয়। ফলে বিনিয়োগ বাড়ছে না।
এতে কিছুটা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্বনর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়বে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ বলেন, উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগের রিটার্ন বিষয়ে অনিশ্চয়তায় থাকে। এছাড়া শেয়ারবাজারও অনিশ্চয়তার জায়গা। তাই মানুষ বিনিয়োমুখী না হয়ে আমানতমুখী হচ্ছে।

তিনি বলেন, যে দেশে হাজার হাজার কোটি চুরি হয়ে গেলেও মানুষ বলে এটা খুব বেশি কিছু নয়, সে দেশে কোটিপতি আমানতকারী বাড়লে তা নতুন আর কী খবর হতে পারে।
বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, আমানতকারীরা ব্যাংকে অর্থ রাখবে আর ব্যাংক তা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করবে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অর্থ সরবরাহ করবে। তারা তা উৎপাদনমুখী খাতে ব্যয় করবে। এতে আয় ও কর্মসংস্থান বাড়বে। এভাবেই হওয়া উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/324177