২৬ মার্চ ২০১৮, সোমবার, ৮:৫৬

বড়দের বাদ দিয়ে ছোটদের কেন সৃজনশীল

সৃজনশীল নামে যা হচ্ছে-শেষ

কসবা টি আলী কলেজের প্রবীণ শিক্ষিকা খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, বর্তমানে এইচএসসি পর্যন্ত সৃজনশীল ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু ডিগ্রি ও অনার্স পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি নেই। ডিগ্রি ও অনার্সের শিক্ষার্থীদের সেই আগে থেকে চলে আসা মুখস্ত ব্যবস্থায়ই পড়ালেখা করতে হচ্ছে। অথচ এ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই সৃজনশীল হতে পারত সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ।
খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, একজন শিক্ষার্থী ছোটবেলা থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে এলো। কিন্তু তারপর আবার তাকে সেই পুরনো দিনের মুখস্ত নির্ভর পদ্ধতিতে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। মুখস্থ পদ্ধতিতে লেখাপড়া করতে হচ্ছে। তাহলে তাকে সৃজনশীল ব্যবস্থা শিখিয়ে লাভ হলো কী।

খোদেজা ইয়াসমীন বলেন, বড়দের সৃজনশীলের আওতায় না এনে ছোটদের ক্ষেত্রে তা চালু করা হয়েছে। এ পদ্ধতি নিয়ে তারা খুবই হিমশিম খাচ্ছে। তাদের অভিভাবকেরাও এটি নিয়ে খুবই অস্থির অবস্থায় রয়েছেন শুরু থেকেই। এটি ঠিক হয়নি।
খোদেজা ইয়াসমীন শিক্ষাবোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের কাজে যুক্ত থাকা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বও পালন করে আসছেন অনেক দিন ধরে। তিনি বলেন, সৃজনশীল চালুর পরও বাস্তবে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করার প্রবণতা কমেনি। এখনো ৯০ শতাংশ বিষয় মুখস্থ করেই উত্তর দিতে হয়। অন্য দিকে সৃজনশীলের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই বইবিমুখ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের হাজী বেলায়েত হোসেন ডিগ্রি কলেজের বাংলার শিক্ষক হারুনুর রশিদ বলেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সৃজনশীল ব্যবস্থা সমর্থনযোগ্য নয়। পঞ্চম শ্রেণীর একটি শিশুকে বলা হয় তোমার এলাকার মুদি দোকান, প্রিয় খেলা, কোথাও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ইংরেজিতে লিখতে। এভাবে বাংলায়ও স্কুলের, এলাকার কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য বা ছুটি চেয়ে দরখাস্ত লিখতে বলা হয়। আমি মনে করি এত ছোট শিশুদের জন্য এসব বিষয় উপযুক্ত নয়। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একটি ছেলে বা মেয়ে ভাষা শেখার পর্যায়ে থাকে। তাদের পক্ষে নিজ থেকে ভাষায় সব কিছু প্রকাশ করার সক্ষমতা তখনো গড়ে ওঠে না। এ বয়স পর্যন্ত ভাষা, চারপাশের পরিবেশ থেকে দক্ষতা অর্জন এবং তা প্রকাশের ক্ষমতা তাদের হয় না। এ বয়স পর্যন্ত তারা শেখে। নিজ থেকে প্রকাশের ক্ষমতা বা সৃজনশীল পদ্ধতিটি আসলে বড়দের জন্য হওয়া উচিত। ছোটদের জন্য এটি ঠিক নয়। তাদের প্রথমে কোনো কিছু শেখাতে হবে। তথ্য জানাতে হবে। পর্যায়ক্রমে তাদের মধ্যে সৃজশীলতার বিকাশ লাভ করে। পারিবেশ থেকে সহায়তা নেয় এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটাতে পারে। কিন্তু এখন যেটি হচ্ছে তাতে আসলে তাদের সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়ার আয়োজন চলছে। বিভিন্ন কারণে শিশুদের ওপর পড়ার যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে তা তাদের জন্য আদৌ শুভ হতে পারে না।
জয়দেবপুরের কাজী রাজিয়া সুলতানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুনের মতে বড়রা মুখস্থ করতে পারে কম। বড় হলে মুখস্থ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই তাদের বেশি দরকার ছিল সৃজনশীল পদ্ধতি। কিন্তু তাদের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি চালু না করে প্রাইমারি স্কুলের ছোট ছোট শিশুদের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

খোদেজা ইয়াসমীন, হারুনুর রশীদ এবং রাবেয়া খাতুনের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেল আরো অনেক শিক্ষকদের কথায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোপালগঞ্জ অঞ্চলের সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, যারা কিছু বোঝে না তাদের গেলানো হচ্ছে সৃজনশীল। যারা বুঝতো এবং যাদের জন্য উপকার হতো তাদের এর বাইরে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি এখন বাদ দেয়ার সময় এসেছে।
শিক্ষকদের সাথে কথা বলার সময় অনেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সৃজনশীলের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। আগের পদ্ধতিতে যে সৃজনশীল ছিল না তা নয়। মুখস্থ প্রবণতা কমানোর আরো অনেক উপায় আছে। প্রশ্নপদ্ধতির ধরন পরিবর্তন করেই সেটি সম্ভব। কোনো শিক্ষার্থী ভালো করে পড়েছে কি না বা তা সে বুঝেছে কিনা সেজন্য কোনো কিছু মুখস্থ লিখতে বলার চেয়েও আরো অনেক সহজ উপায় রয়েছে। কিন্তু মুখস্থ করার প্রবণতা বাদ দিতে গিয়ে এখন যে পদ্ধতি চালু করা হলো তাতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটি যে জাতির জন্য কল্যাণকর হয়নি তা তো বারবারই বিভিন্ন ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষার মানের এত অধঃপতন আগে কখনো দেখেনি জাতি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/304964