২৪ মার্চ ২০১৮, শনিবার, ১২:১৮

মানুষের আস্থার সব কেন্দ্র একে একে হারিয়ে যাচ্ছে

একের পর এক আস্থার কেন্দ্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন ও পুলিশের রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের ফলে প্রশাসন ও নিরপেক্ষ বাহিনীর প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। শেষ আশ্রয়স্থল ছিল আদালত, সেখানেও আস্থা রাখতে পারছে না বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। গণতন্ত্রের বড় ভিত্তি হলো নিরপেক্ষ প্রশাসন, পুলিশ এবং আদালত। আর এতে সমস্যা হলো গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নড়বরে হয়ে ওঠে।

আজ নির্বাচনের বছরে গণতন্ত্র যেন সবচেয়ে বেশী সংকটে। সরকারি দল সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপর দিকে বিরোধী দলকে কোন কর্মসূচিই পালন করতে দেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হলেও, একে দিয়ে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশ্ন থাকার কারণ রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো, প্রশাসনের দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক কাজে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ব্যবহার। নির্বাচনের সময় প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ বিপুলসংখ্যক লোককে সুষ্ঠুভাবে তত্ত্বাবধান করা সম্ভব কিনা এটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশন এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগকর্তা নয়। ফলে এরা যদি কমিশনের কথা না শোনে তাহলে কমিশনের পক্ষে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা সীমিত।
বর্তমান প্রশাসন ও সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মীজানুর রহমান শেলী। তিনি বলেন, বর্তমান প্রশাসনের সব জায়গায় দলীয়করণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সরকার ও সামরিক শাসনামলেও এত দলীয়করণ প্রশাসনে ছিল না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ প্রশাসন দরকার।

সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, বাংলাদেশের সিডিআরবি চেয়ারম্যান ড. শেলী বলেন, গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোকে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ না দিলে দেশে একদিন মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। এজন্য দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা খুবই প্রয়োজন। তিনি বলেন, যদিও বর্তমান সময়ে সমঝোতা অসম্ভব মনে হচ্ছে কিন্তু আসলে অসম্ভব নয়। আর যদি সমঝোতা না হয়, হিংসা-হানাহানি চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে কেউ ক্ষমতায় একবার এলে সে আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। কারণ, ক্ষমতায় থেকে তারা এমন সব অপকর্ম করে পরে মনে করে ক্ষমতা ছাড়লে তারা জনগণের রোষের মধ্যে পড়বে। তাই এ বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন।

পুলিশেও আস্থাহীনতা: ইংরেজি পুলিশ (POLICE) শব্দটি বিশ্লেষণ করে বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তন্মধ্যে জনপ্রিয়টি হলো- (Polite) ভদ্র, (Obedient) বাধ্যগত, (Loyal) দায়িত্বশীল, (Intelligent) বুদ্ধিমান, (Courageous) সাহসী ও Efficient (দক্ষ)। বাংলাদেশের পুলিশদের অনেকের মধ্যে এর সবগুলো গুণেরই অভাব রয়েছে।

বিশিষ্টজনরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পুলিশে লোক নিয়োগ করা এবং পুলিশদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণেই দেশের এই মহাসর্বনাশটা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা পেশাগত অসদাচরণ ও চাকরিবিধি লঙ্ঘন দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ও নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের মুখে প্রায়শই রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। যা আমাদের দেশের গণমুখী প্রশাসন গড়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়ই বলতে হবে।
পুলিশের কতিপয় সদস্যের হিংস্র আচরণে পুলিশ কর্মকর্তারাও হতবাক। সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনকে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসতে দেখা গেছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে বলে আপাতত মনে করা হচ্ছে। মোহাম্মদপুরে ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা ও নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধ করে বেড়ালেও শাস্তি পেতে হয়েছে এমন নজির খুব একটা দেখা যায় না। কোনো কোনো ঘটনার পর অনেকেরই রহস্যজনকভাবে সুবিধাজনক স্থানে পদায়ন পর্যন্ত হয়। ফলে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে নানাবিধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। কারণ, তাদের অপরাধের কোন বিচার বা শাস্তি হয় না।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্বলতা, সংকীর্ণ দলীয় মনোবৃত্তি, পুলিশে দলীয়করণ ও পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল করার কারণে পুলিশে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশ বাহিনীতে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন নৈতিক মানদ- বিবেচনায় আনা হচ্ছে না বরং যারা দলীয় রাজনীতির লেজুরবৃত্তি করছে তাদেরকেই এই বাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে পেশাদারিত্ব হারাতে বসেছে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ এই বাহিনী। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয় বা হচ্ছে বলে শোনা যায়নি।

স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অশুভ সংকেত: জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার দীর্ঘ সময় পর রায়ের সার্টিফাইড কপি পাওয়া যায়। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, সরকারের ইচ্ছামত খালেদা জিয়ার রায় দেয়া হয়েছে এবং তাদের ইচ্ছামতোই রায়ের কপি দিতে বিলম্ব করা হচ্ছে। শুধু বিএনপিই নয়; নিম্ন আদালতে দেয়া বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের সার্টিফাইড’ কপি’ নিয়ে কালক্ষেপণ ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়’ মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রুলস অনুযারী ৫ দিনের মধ্যে বিচারপ্রার্থীর নিম্ন আদালতের সার্টিফাইড কপি পাওয়ার কথা। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাননি। যা স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অশুভ সংকেত।

সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তিন দিনের মধ্যে তার (খালেদা জিয়া) জামিন দেয়ার কথা। অবাক লাগছে। দেশে যেভাবে হত্যা গুম চলছে তা নিয়ে সবাইকে মুখ খুলতে হবে। জজ সাহেবদের এ ব্যাপারে অসহায়দের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলে কেন তারা দেশে গুম হত্যা অপহরণের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না? তারা যদি গুম হত্যার বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারে তাহলে বেরিয়ে যাক ক্ষমতা থেকে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, সত্য কথা বলতে কি দেশে আইনে শাসন নেই। আইনের শাসন থাকলে আজকের যা হচ্ছে তা হতো না। জাজমেন্ট হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কি যুদ্ধ ঘোষণা করলো। তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগ এখন স্বাধীন নয়। সরকারে সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ড বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ করছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিও বলেছিলেন নি¤œ আদালত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আমারও তাই মনে হয় সরকারের বিচারিক আদালতের উপর প্রভাব বিস্তার করছে। এতে করে বিচার বিভাগে প্রতি জনগনের আস্থার সংকট সৃষ্টি করছে বর্তমান সরকার। এটা বিচার বিভাগে জন্য সুখকর নয়।
সরকারি সুবিধা নিয়ে প্রচারণায় সরকারি দল, বিরোধীদের পথরুদ্ধ: গত জানুয়ারিতে সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। তাদের শরীক অন্যান্য দলও সভা সমাবেশ করে যাচ্ছে। সরকারি জোটের অন্যতম শরীক জাতীয় পার্টিও আগামীকাল শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়াদী উদ্যানে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের সভা সমাবেশে চলছে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। কর্মসূচি ঘোষণা করেও দিনের পর দিন অনুমতি পাচ্ছে না বিএনপি। শান্তিপূর্ন মানববন্ধনও করতে পারছে না তারা। অপর দিকে দীর্ঘ দিন যাবত সভা সমাবেশ করতে দিচ্ছে না ২০ দলের অপর শরীক দল জামায়াতে ইসলামী।

এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, সরকারি খরচে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। এসব বন্ধ করতে হবে। না হলে বিএনপিকে জনসভা করার সমান সুযোগ দিতে হবে। মওদুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারাভিযানে নেমে গেছেন। নৌকায় ভোট চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরে ভোট হবে। সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়। কিন্তু প্রায় এক বছর আগেই সরকারি দল রাষ্ট্রীয় খরচে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে। প্রশ্ন জাগে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আসলে কী?
ইসির উদ্দেশে তিনি বলেন, বিএনপিকে কোনো ঘরোয়া সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হয় না। আর সরকারি অর্থ খরচ করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। নৌকা মার্কায় ভোট চাইছেন। তাহলে বিএনপিকেও সমান সুযোগ দিতে হবে। বিএপিকেও ধানের শীষে ভোট চাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

এই অসম পরিস্থিতিতে জেল-জুলুম, মামলা-হামলার পাহাড় মাথায় নিয়ে বিরোধী দল নির্বাচনে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ২০১৪ সালের মত নির্বাচনও আর সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সংকট আরও তীব্র হবে। মানুষের আশা-আস্থার কেন্দ্রগুলোর ধসে পড়ার এই অবস্থা তাদের হতাশাকে সীমাহীন করে তুলবে। সচেতন মহল কেউ একে দেশ ও জনগণের জন্যে কল্যাণকর মনে করছে না।

http://www.dailysangram.com/post/323777