প্রতীকী ছবি
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার, ১১:২৭

সড়ক নিরাপত্তায় বরাদ্দ নেই, বাড়ছে দুর্ঘটনা

♦ গড়ে প্রতিদিন ১১ জনের প্রাণহানি
♦ বছরে ক্ষতি ৪০ হাজার কোটি টাকা
♦ ৪৭ দিনে ৪৮৫ জনের মৃত্যু

সড়ক নিরাপত্তা খাতে বিনিয়োগ সংকটে জনসচেতনতা তৈরির কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিদিন দেশে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটছে। আর সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তার পরও দুর্ঘটনা কমাতে এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ এবং প্রকল্প নেই। অবকাঠামো উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্পে ব্যয় বাড়ানো হলেও সড়ক নিরাপত্তা খাতে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কিংবা এ খাতের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে সহায়তা দিতে উদ্যোগ নেই।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবিতে ২৪ বছর ধরে কাজ করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তাঁর মতে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা তৈরিতে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে দরকার দক্ষ চালক তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই খাতে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ওই অর্থ আর পাওয়া যায়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। অর্থ সংকটে বেসরকারি সংস্থাগুলোর জনসচেতনতা তৈরির কার্যক্রমেও ভাটা পড়ছে। গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছি।’ তিনি বলেছেন, জনগণের অর্থ জনগণের নিরাপত্তার কাজে লাগাতে কেউ বাধা দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

জনসচেতনতা তৈরির কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। বেসরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন গড়ে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটছে। গত ৪৭ দিনের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৭ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রাণহানি হয়েছে ৪৮৫ জনের। শুধু জানুয়ারি মাসেই প্রাণ হারিয়েছে ৪২৫ জন। চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে প্রাণহানি ঘটেছে ৬০ জনের। গতকাল কালের কণ্ঠ’র কাছে ৯ জনের প্রাণহানির তথ্য এসেছে সাভার, হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে।
গাড়িচালক, যাত্রী, মহাসড়ক পুলিশ ও গবেষকরা বলছেন, গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানো, অনুমোদনহীন তিন চাকার বাহনের ব্যাপকতা, রাতে ট্রাকসহ ভারী যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল, ভুয়া চালক বেড়ে যাওয়া, ভাঙাচোরা সড়ক সংস্কার না হওয়া, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় পথচারীবান্ধব সড়ক অবকাঠামো না থাকার কারণে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুসারে, দুর্ঘটনায় যে প্রাণহানি ঘটছে তার মধ্যে ৫১ শতাংশ পথচারী।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। গতিসীমা লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রণে আনতে ডিজিটাল জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়ির তুলনায় প্রকৃত চালক কম। তাদের হাতেই প্রাণ নিয়ে পথে চলতে হচ্ছে। আমরা এ জন্য ছয় মাস আগে দুটি কর্মপরিকল্পনা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। এসব প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।’
গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যৌথভাবে ডিজিটাল তদারকি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করলেও অনুমোদন মিলছে না। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে দুই হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক ৪০টি অংশে ভাগ করে কেন্দ্রীয়ভাবে তদারক করতে ২৪ ঘণ্টা সচল রাখা হবে স্পিড এনফোর্সমেন্ট ক্যামেরা। গাড়ির ছবি, নাম্বার প্লেট ও গতি রেকর্ড করা হবে। আইন অমান্য করলেই মোতায়েন করা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। থাকবে মোবাইল হাসপাতাল, যাতে আহতদের দ্রুত চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়। মহাসড়ক পুলিশ, মহাসড়কের পাশের ১২০টি ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা এ কাজে সহায়তা করবেন।

ড. মোয়াজ্জেম আরো বলেন, মেগা প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৫ শতাংশ সড়ক নিরাপত্তা খাতে খরচ করলে সড়কে দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ববরণের হার কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি উন্নয়নশীল দেশে মোট জিডিপির ১ থেকে ৩ শতাংশ। আমাদের দেশে জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। এ হিসাবে বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ৭০ শতাংশের বেশি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যই সংগ্রহ করা হচ্ছে না। দেশে অনুমোদিত যন্ত্রচালিত গাড়ি রয়েছে প্রায় ৩০ লাখ। আরো ৩০ লাখ গাড়ি আছে অযান্ত্রিক। তিন চাকার বাহন নিষিদ্ধ করার পর সড়কে দুর্ঘটনা কমে এলেও তা আবার বাড়তে শুরু করেছে।
গবেষকদের মতে, দেশের ৯০ শতাংশ মহাসড়কই আদর্শ মানের নয়। এসব মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিবেগ হতে পারে ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চালানো হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিবেগে। গাড়ির সিলিন্ডার পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণহানির ভয়াবহতা বাড়ছে।
সরকার ২০২০ সালের মধ্যে সড়কে প্রাণহানি ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার কর্মকৌশল নিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পুলিশ, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সওজ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কর্মসূচি নেতিয়ে পড়েছে।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, লক্ষ্য আছে, কর্মসূচি আছে, সমন্বয় নেই। বিনিয়োগও নেই। ফলে লক্ষ্য অর্জন করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন কী পরিমাণ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে তার তথ্য জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্ভিস ও পুলিশের কাছ থেকে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদে আসছে না। এটিকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার বিনিয়োগ করলে নিশ্চয়ই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/02/20/604414