২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫১

শিক্ষা নিয়ে দলবাজির সুযোগ নেই

বছর ফুরিয়ে এলে মানুষ পেছন ফিরে তাকায়। বুঝতে চেষ্টা করে বিদায়ী মাসগুলোয় জীবনে কী ঘটে গেছে? আবার বছর ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে জীবন ছোট ও বড় হওয়ার প্রশ্নটি জড়িত থাকে বলেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতিতে বাংলা বছরের গুরুত্ব থাকলেও ইংরেজি দিনপঞ্জি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জীবনে ইংরেজি বছর নতুন আকর্ষণ নিয়ে আসে। এই আগমনী বার্তা যাতে নিরাপদ হয় সেজন্য রাষ্ট্রও সতর্ক হয়ে ওঠে।

ইংরেজি যে বছরটি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার শেষ সপ্তাহে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, বছরটি কেমন ছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, বছরের কোনো ঘটনাগুলো এদেশের মানুষের জীবনকে আন্দোলিত করেছে? তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী বছরটি কেমন যাবে? মানুষ গণক নয় বলেই আগামী দিন সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারে না, তবু ভবিষ্যদ্বাণী শুনতে পছন্দ করে। বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক ঘটনাগুলো তীব্র উত্তাপ ছড়ায়নি। অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ভ্রান্ত বিশ্লেষণের কারণে চাপা পড়েছে। কিন্তু যে ঘটনা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে এবং যার সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ পথচলা জড়িত, তা হচ্ছে শিক্ষা। এই বছর দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ আছে কিনা, তা কেউ জানেন না।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক আলাপ-আলোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। পাকিস্তানি ঐতিহ্যের অনুসরণে অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে- কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়নি। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চরমে পৌঁছেছে, শিক্ষাব্যবস্থা পতিত হয়েছে হতাশার অন্ধকারে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বছরজুড়ে যেসব ঘটনা মানুষকে উৎকণ্ঠিত করেছে তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের ভর্তি ও ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী সমাপনান্তে পরীক্ষা, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য, স্কুলে স্কুলে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারের জন্য নিজস্ব ছাত্র সংগঠনের অনুপ্রবেশ, প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন এবং দুর্নীতি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর আত্মস্বীকৃতি।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা শুধু রাজধানী বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সীমিত নেই। অবিশ্বাস্য হলেও এখন প্রাথমিক পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে মূলত শিক্ষকরাই জড়িত থাকেন। এমন নয় যে, একটি প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক জড়িত থাকেন। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত কোথায় ঘটে, সে বিষয়ে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলেন না। শুধু কিছু লোককে গ্রেফতারের মধ্যেই প্রক্রিয়াটি সীমাবদ্ধ থাকে।

কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই আয়োজন কেন? অভিযোগ রয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য জড়িত। প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য যে কারণটি সবচেয়ে বেশি দায়ী তা হচ্ছে, অর্থহীন শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে জিপিএ’র মাত্রা দিয়ে শিক্ষা অর্জনের বিষয়টি মাপা হয়। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর একজন ছাত্রের জীবনে জিপিএ কী আদৌ গুরুত্বপূর্ণ? নাকি শিশুরা কী পড়ছে এবং কী শিখছে- সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী শেষে প্রতিযোগিতার পরীক্ষা। এই দুটি পরীক্ষা শেষে যে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তার মূল্য কী? বলা হয়, এ দুই শ্রেণী শেষে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণে শিক্ষার্থীদের ভয় কেটে যাবে। অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি। শিক্ষার্থী নিজেও জানেন, মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষে যে এসএসসি পরীক্ষা, তা এসবের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং শঙ্কাও অনেক বেশি। আর যারা অতীতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী শেষে পরীক্ষা না দিয়ে ম্যাট্রিক বা এসএসসি পাস করেছেন, তারা কি ভয়ে কাতর হয়ে গিয়েছিলেন? কেমন করে, কী করে এ দুটি পরীক্ষা এবং সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকে পড়েছে, তার খবর অনেকেই রাখেন না। বিদেশিদের চাপে আমাদের যে অনেক কিছু করতে হয়, শিক্ষাব্যবস্থার এই গবেষণা তারই বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেভাবে পাঠদান করা হয়, তা আর যাই হোক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্রের জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু। রাজনৈতিক কারণে সরকার নতি স্বীকার করে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করেছে কিন্তু এজন্য দায়ীদের সম্পর্কে কিছু বলছে না। সরকার নিজেই যেহেতু এই পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত, তাই কেউ শাস্তি পায় না। বুদ্ধিজীবীরাও আর প্রতিবাদী আন্দোলনে উৎসাহ বোধ করেন না। প্রশ্ন হল, এ আপসকামিতা নিয়ে সরকার কীভাবে ধর্মীয় প্রভাবকে বা ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের মোকাবেলা করবে? ব্যাখ্যাটি সহজ; মূলত ভোটের রাজনীতির কারণেই সরকার এসব বিষয়ে কোনো কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু এতে কি শেষ রক্ষা হবে? পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ছাপার দায়িত্বে আছে টেক্সট বুক বোর্ড। এসব প্রশ্নে তারা একেবারেই উদাসীন। প্রশ্নের মুখে জবাব দেন, বিষয়টি দেখা হবে। কিন্তু দেখা হবে না- ভিন্ন চিন্তা পাঠ্যপুস্তককে গ্রাস করবে। অবশ্য ভিন্ন চিন্তার কণ্ঠ রোধের বিষয়টি আরও আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, যখন মওলানা ভাসানী পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসৃত হয়েছেন। এই অপসৃতি ও অস্বীকৃতি শেষ পর্যন্ত কল্যাণ বয়ে আনে না।

বছরের প্রায় শেষদিকে এসে দুর্নীতি সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনেককে অবাক করেছে। সংবাদপত্রে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি নিজেকেও দুর্নীতিবাজ বলেছেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বক্তব্য ছিল- আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতার করা হোক। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় মনে করে প্রকাশিত সংবাদে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ আছে। শিক্ষামন্ত্রী পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ল্যাপটপ ও প্রশিক্ষণ সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী এ অধিদফতরের অতীতের আট বছর আগের উদাহরণ দিতে গিয়ে ডিআইএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কথা তুলে ধরেন।’ ব্যাপারটা বোঝা গেল কিন্তু মন্ত্রী নিজেকে দুর্নীতিবাজ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। এই প্রথম বাংলাদেশে একজন ব্যক্তি পরপর দুবার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বছর শেষে নতুন বইয়ের প্রকাশনা ছাড়া তার ঝুলিতে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই।

জিপিএ’র মোহে শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের জন্য এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের স্কুল শাখা খোলার কথা বলা হচ্ছে! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অবশ্য এই প্রয়াসের সম্ভাব্য ব্যর্থতার কথা অনুমান করতে পেরে বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি ধারণাটি ঠিক নয়। এই মুহূর্তে সমালোচনা ডেকে আনার দরকার নেই।’ সমালোচনা না হলে কি ধারণাটি ঠিক ছিল বলা যাবে? এটা একটি অনাকাক্সিক্ষত পদক্ষেপ। উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কল্যাণে ভিন্নমতের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাঙ্গনে উপস্থিত থাকতে পারেন না। স্কুলে ছাত্রলীগের পাশাপাশি অন্য ছাত্র সংগঠনের শাখা খোলা হলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে। সে দায়িত্ব কে নেবে? এমনিতে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে ইতিমধ্যে দু’জন মারা গেছে।

আজ যে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন তা হচ্ছে, শিক্ষা নিয়ে দলবাজি করার সুযোগ নেই। ভর্তির হার বাড়িয়ে অহঙ্কারী হওয়া যেতে পারে, কিন্তু দেশে শিক্ষার মানের যে অবনতি ঘটেছে, তা কেউ বলছেন না। অনেকে অভিযোগ করেন, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি কেনা যায়। যিনি চাকরি কিনবেন, তিনি নিঃসন্দেহে যোগ্য হবেন না। অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন, শিক্ষার মানের অবনতি কোন পর্যায়ে গেছে? এই মান সম্বল করে বাংলাদেশ কোনো কিছুই অর্জন করতে পারবে না। এমনকি এমন সময় আসবে, যখন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি পাওয়া যাবে না।

শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করার কারণে পরীক্ষায় প্রথম হয়েও একজন চাকরি পায় না, কারণ তার বংশে আওয়ামী লীগের সমর্থক নেই। এক্ষেত্রে সরকারের জন্য সমস্যার সমাধান একটিই- একদলীয় ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। কিন্তু একদলীয় শাসন কি টেকসই হবে? বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সে কথা বলে না।

মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক

 

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/12/28/182944