২৮ ডিসেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫০

কিছু আপদের কথা

শিশুদের আমরা সবাই ভালবাসি। যারা শিশুদের ভালবাসে না তাদেরকে আমরা সুস্থ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করি না। শিশুদের ক্ষতিতো আমরা কেউ চাই না। কিন্তু আমরা জানি কি অসচেতনতার কারণে ঘরের এবং বাইরের মানুষরা প্রতিদিন শিশুদের ক্ষতি করে চলেছি? আসলে বাংলাদেশের শিশুদের বিরাট অংশ ধূমপানের বিষক্রিয়ার শিকার। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন আছে। পরোক্ষ ধূমপান নিকোটিন উপস্থিতির কারণ। রাজধানীর মিরপুর এলাকার ছয়টি ও সাভার এলাকার ছয়টি প্রাথমিক স্কুলের ৪৭৯টি, শিশুর লালা পরীক্ষায় ক্ষতিকর নিকোটিন পাওয়া গেছে। গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘নিকোটিন এন্ড টোবাকো রিসার্চ’ সাময়িকীতে ৭ ডিসেম্বর মুদ্রিত হয়েছে। উক্ত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের ওপর পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব কমানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে এই গবেষণা করেছে। উক্ত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক বলেন, ‘বাসায় বাবা, বড় ভাই বা অন্য কেউ ধূমপান করে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু। রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকে সিগারেট খান, সেই ধোঁয়া যায় শিশুর শরীরে। এই পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব নিয়েই আমাদের গবেষণা।’ গবেষণার ফলাফলকে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক বলেছেন বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি চিকিৎসক অধ্যাপক আলী হোসেন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির অন্যতম প্রধান কারণ এই পরোক্ষ ধূমপান। বাবা, বড় ভাই বা পথচারী যে ধোঁয়া ছাড়ছেন তার শিকার হচ্ছে শিশুরা। ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া এই বিপদ থেকে শিশুদের রক্ষার উপায় নেই।’ ঘরে-বাইরে বড়দের ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের আদরের শিশুরা। প্রশ্ন জাগে, কেন আমরা ক্ষতিকর এই কাজটি করছি? আমরা তো জানি ‘ধূমপানে বিষপান’। এছাড়া ধূমপানে তো পরিশ্রমলব্ধ অর্থের অপচয় হয়। আর ইসলাম ধর্মে তো অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সামগ্রিক ক্ষতির দিক বিবেচনা করে ইসলামিক স্কলাররা ধূমপান তথা তামাক সেবনকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। ফলে ধূমপান পরিহার করাই কি সঙ্গত নয়?

আমাদের ধূমপানের ঝুঁকি রয়েছে, ঝুঁকি রয়েছে গণপরিবহনেও। গণপরিবহনের যাত্রীদের মৃত্যুঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে। দেশে একের পর এক চলন্ত বাসের গ্যাস সিলিন্ডারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর শাহবাগে একটি চলন্ত বাসে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। এমন আরও দেড় লাখ গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার এখন মেয়াদহীন হওয়ায় মৃত্যুবোমা নিয়ে ঘুরছে মানুষ। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অবহেলায় ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্টরা। শাহবাগে বাসের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় দ্রুতগতিতে বাস থেকে নেমে পড়েন যাত্রীরা। এ সময় প্রবীণ এক মহিলা নামতে গিয়ে পাড়ে যান। তাকে পদদলিত করেই বেরিয়ে পাড়েন অন্যরা। গাড়ির ইঞ্জিনে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। লেলিহান শিখায় পুরো বাসটি পুড়ে কংকাল হয়ে যায়।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সদ্য চালু হওয়া ন্যাশনাল হেল্পডেস্কের ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বাসে আগুন লাগার তথ্য দেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী। এরপর ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতর থেকে তিনটি ইউনিট ও পলাশী ফায়ার সার্ভিস স্টেশন থেকে আরও দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। মূলত গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ হয়ে গাড়িতে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনায় ন্যাশনাল হেল্পডেস্কের ৯৯৯ নম্বরের গুরুত্ব ভালোভাবেই উপলব্ধি করা গেল। সার্ভিসটির মান যেন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে অব্যাহত থাকে সে ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বিস্ফোরণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, একটি গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ ৫ বছর। এরপর মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রিটেস্টিং করা উচিত। প্রয়োজনে সিলিন্ডার বদলে ফেলা উচিত। কিন্তু এতে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় সংশ্লিষ্ট গাড়রি মালিকরা তা করছেন না। গাড়িতে লাগানো গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বিস্ফোরক অধিদফতরে রিপোর্ট জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে মাত্র ১৫ হাজার গাড়ি পরীক্ষার হালনাগাদ রিপোর্ট জমা আছে। অন্যগুলোর ব্যাপারে কিছুই জানে না বিস্ফোরক অধিদফতর। গাড়িতে গ্রাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এখন এক নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই সময়ের দাবি অনুযায়ী সরকারি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যৌক্তিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে আমাদের আর এক আপদ চাঁদাবাজি। ‘ঘাটে ঘাটে শুধুই চাঁদাবাজি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায়। ১১ ডিসেম্বর তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনে বলা হয়, চাঁদাবাজি ধান্দার কাছে জীবনযাত্রা বাঁধা পড়ে আছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই চলছে চাঁদাবাজির ধকল। ব্যবসা-বাণিজ্য নিশ্চিত রাখতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঠেকাতে, সর্বোপরি প্রাণ বাঁচাতেও কাউকে না কাউকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কবল থেকে রক্ষা পেতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য পেতেও দিতে হয় আরেক ধরনের চাঁদা।
রাজধানীর বাসাবাড়িতে নবজাতক জন্মালেও চাঁদার হাত বাড়ায় একদল হিজড়া। এমনকি কবরস্থান থেকে লাশ চুরি ঠেকাতেও মাসোহারা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। চাঁদাবাজি থামছে না কিছুতেই। রাজধানীর ফুটপাত থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন বহুতল ভবন পর্যন্ত চলছে চাঁদাবাজি। ভুক্তভোগীদের মতে চাঁদাবাজির ধরনেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। পাল্টে গেছে চাঁদার পরিমাণ ও স্টাইল। আগে কেবল শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি করতো, এখন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগীদের সাথে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গ্রুপ।

রাজধানীর ফুটপাত ও পরিবহন সেক্টরে বিস্তৃত চাঁদাবাজির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। রাজধানীর ফুটপাতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে লাইনম্যান নামধারীরা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টনসহ আশপাশের ফুটপাত থেকেই মাসে কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। এসব চাঁদাবাজি বন্ধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৭২ জন চাঁদাবাজকে চিহ্নিত করে মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলার পর চিহ্নিত চাঁদাবাজরা মামলার খরচের নামে চাঁদার রেট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৪২ পয়েন্টে ফুটপাত ও ১৪টি স্থানে অবৈধ হাটবাজার বসিয়ে চাঁদাবাজরা বছরে কোটি কোটি টাকা তুলছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ আর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট এসব টাকা ভাগ করে নিচ্ছে। ফলে নানা উদ্যোগের পরও ফুটপাত-রাস্তা দখলমুক্ত হয় না। দূর হয় না নগরবাসীর ভোগান্তি। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য থামানোর সাধ্য যেন কারো নেই। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পরিবহন চাঁদাবাজদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় র্যা ব-পুলিশের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। একশ্রেণীর পরিবহন শ্রমিক চিহ্নিত, সন্ত্রাসী, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক-মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। চাঁদাবাজির অত্যাচারে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন রুটে পরিবহন ধর্মঘট পর্যন্ত হচ্ছে।

চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাতে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে তেমন কাজ হবে বলে মনে হয় না। আর নগদ এতো অর্থের লোভ সামলানো কোন সহজ কাজ নয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শুধু মাস্তান কিংবা সন্ত্রাসীরা নয়, চাঁদাবাজির সাথে জড়িয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী এবং একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যও।
এসব বিষয় বিবেচনায় আনলে সরকার, সিটি কর্পোরেশন ও প্রশাসনকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও কৌশলের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ ও নীতিনিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু প্রচার-প্রোপাগান্ডার বদৌলতে চাঁদাবাজির বর্তমান সা¤্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আজ ধূমপান, গণপরিবহনের ঝুঁকি ও চাঁদাবাজির আপদ নিয়ে কিছু কথা বলেছি। এইসব আপদ দূর করা কোনো অসম্ভব কাজ নয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে গণসচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং আদর্শের রাজনীতি। আর যে সব রাজনীতিবিদ পরিবহন সেক্টরে ও ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে মগ্ন থাকে, তাদের অবশ্যই বর্জন করতে হবে আমাদের।

 

http://www.dailysangram.com/post/312945