২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:৫০

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার বছর

চলতি বছর কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আকস্মিক পরিবর্তন ও খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাত ছিল আলোচনায়। পর্ষদ সদস্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, অব্যবস্থাপনা আর অদক্ষতার কারণে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এ খাতে। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও নিশ্চুপ। ফলে এ খাতে বেড়েছে ঝুঁকি। অবশ্য সম্প্রতি এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করে কিছুটা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত ‘গ্লোবাল কম্পিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৭-১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অস্থিরতার চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সরকারি ব্যাংক খাত মৃতপ্রায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এত দিন সরকারি ব্যাংকের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ থাকলেও এখন তা বেসরকারি ব্যাংকেও ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া নতুন কয়েকটি ব্যাংকের টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে গেছে। ভালো চলছিল বেসরকারি ব্যাংকখাত। কিন্তু সরকারি হস্তক্ষেপে এই বেসরকারি ব্যাংক খাতও অস্থির হয়ে পড়েছে। এছাড়া ব্যাংকখাতের শীর্ষ ব্যক্তিদের মতে, যে পদ্ধতিতে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তাতে গ্রাহকদের আস্থা হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৭টি। এর মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থাই খারাপ। ঘটেছে একের পর এক অস্বাভাবিক বড় বড় কেলেঙ্কারি। এর মধ্যে সোনালী ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি ইত্যাদি। সম্প্রতি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও এর আগে ইসলামী ব্যাংক মালিকানা পরিবর্তনের ঘটনা ব্যাংকিং খাতকে চিন্তায় ফেলেছে। সর্বশেষ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিবর্তনেও বেশ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও আস্থাহীনতা ও চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এছাড়া নতুন করে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয়া ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা পর্ষদে রদবদলের কারণে অর্থ হরিলুটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ফলে গোটা ব্যাংকিং খাতের প্রতিই আমানতকারীর আস্থা নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংক। মালিকানা পরিবর্তনের পর ব্যাংকটিতে দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। বেড়েছে খেলাপি ঋণ। নতুন পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংকটির ওপর একটি গ্রুপের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা অনেকেই ব্যাংকটি থেকে তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে নিচ্ছেন। কমে গেছে রেমিট্যান্স সংগ্রহও।

এদিকে অতি সম্প্রতি সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডও (এসআইবিএল) একটি বিশেষ গ্রুপের দখলে চলে গেছে। গত ৩০শে অক্টোবর এসআইবিএল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন হয়। ওইদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)কে হঠাৎ পদত্যাগ করতে হয়। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের পর পরিচালনা পর্ষদের সভায় এক সঙ্গে ৭ পরিচালক পদত্যাগ করেন। ওই সভায় নতুন করে আরো ৯ পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হয়। জানা গেছে, ২০১০ সালের পর পরিচালকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পরিচালক হওয়া, ব্যাংক পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, পরিচালকদের বেনামি ঋণ নেয়াসহ নানামুখী সংকটে পড়ে এসআইবিএল।

ওদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থাও শোচনীয়। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরুর পর বছর না ঘুরতেই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটি। তারল্য সংকটে পড়ে নিয়মমতো বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া গ্রাহকরা চেক দিয়েও টাকা পাচ্ছেন না। ব্যাংকটি নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে ‘ঝুঁকি’ বাড়ায় পর্যবেক্ষক বসানো ছাড়া এই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংক চালাতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ২৭শে নভেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এ ছাড়া ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক মাহাবুবুল হক চিশতীকেও পদ ছাড়তে হয়। গত সেপ্টেম্বর শেষে ফারমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৩৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৭.৪৫ শতাংশই খেলাপি। এ ব্যাংকের মূলধনেও ৭৫ কোটি টাকা ঘাটতি হয়েছে। এদিকে ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার জন্য ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) একেএম শামীমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি ফারমার্স ব্যাংককে আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, ব্যাংকটি সাধারণ আমানতকারী এবং বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে অর্থ নিয়ে ধার করে চলছে। ফলে ব্যাংকটি সমগ্র আর্থিক খাতে ‘সিসমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে। এতে আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে বলেও মনে করছে মন্ত্রণালয়। ২৯শে অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দেয়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

সর্বশেষ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি পদে রদবদল করে পরিচালনা পর্ষদ ঢেলে সাজানো হয়েছে। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে পরিবর্তন এসেছে। এক জরুরি পর্ষদ সভায় এসব পরিবর্তন করা হয়। সভায় প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান ফরাছত আলীকে সরিয়ে নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন তমাল এস এম পারভেজ। ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক রহমান চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মনজুরুল ইসলাম, নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুন নবী ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুনসেফ আলীকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এমডি দেওয়ান মুজিবর রহমানকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এ পদে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ডিএমডি কাজী মো. তালহাকে।

অন্যদিকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বোর্ড সভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী করা হয়েছে। নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণের হারের বিবেচনায় এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফারমার্স ব্যাংক রয়েছে প্রথম অবস্থানে।
সংসদ সচিবালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করে ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। ইসলামী ব্যাংক নিয়েও সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক এগ্রেসিভ লোন দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকখাতের অভিভাবক বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তাদের মতে, নিয়ম হচ্ছে পর্ষদে নতুন পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পরিবর্তন আনা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া তা কার্যকর হবে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সময় নিয়ে থাকে। অথচ এসআইবিএলের ক্ষেত্রে রাত ১০টা পর্যন্ত কার্যালয় খোলা রেখে ওই দিনই অনুমোদন দেয়া হয়। গত ৫ই জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ছিল এ রকমই।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোর অবস্থান নিতে পারতো এসবের বিরুদ্ধে। তাদের ব্যর্থতায় এগুলো হচ্ছে। আর সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সরকারকেই দায়ভার নিতে হবে। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোতে পর্ষদ সদস্যের পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা ব্যাংক খাতের সুশাসনের জন্য অন্তরায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, ব্যাংকের এমডি যদি শক্ত অবস্থান না নেয়, চাকরি হারানোর ভয়ে যদি কাজ করে তবে তা দুঃখজনক। এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ব্যাংক দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের সমীক্ষাই হচ্ছে বাংলাদেশে এত ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। তারপরও অনুমোদন দেয়া হয়।
এদিকে ‘ডব্লিউইএফ প্রকাশিত গ্লোবাল কম্পিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৭-১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫১ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন ব্যাংকিংখাতে অনিয়ম রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন কমানো হয়েছে। ব্যাংকিংখাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বড় আকারের মন্দ ঋণ আদায় হচ্ছে না। বড় বড় কোম্পানির কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=97912