২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:২৯

চট্টগ্রামে ৫০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা

‘টোকেন’ ও ‘রসিদ’ থাকলে নিবন্ধন কোনো বিষয় নয়

মাসে কোটি টাকা চাঁদা তোলে পুলিশ-ক্ষমতাসীন দল

‘রাস্তায় নামলে প্রতিদিন ২০ টাকা করে মাসে ৬০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় ওয়ে বিলের (চলাচলের জন্য)। আবার টোকেনে মাসে ৩৩০ টাকা দিতে হয় লাইনম্যানকে।
এর বাইরে ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে কয়েকটি রাস্তায় গাড়ি চালালে তাদের মাসে ৬০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা দিতে হয়। আবার কাগজপত্র ঠিক না থাকলে বা অতিরিক্ত যাত্রী নিলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তাহলে সংসার চালাব কিভাবে?’

চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন মোড়ে আক্ষেপ করে বলছিলেন সিএনজি অটোরিকশাচালক সেলিম উদ্দিন। জানালেন রংপুর থেকে চাকরির জন্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন তিন বছর আগে। এখন তিনি সিএনজি অটোরিকশা চালান।
গাড়ির মালিকের পরিচয় প্রকাশ না করে চালক সেলিম গত শনিবার সকালে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার গাড়ি চট্টগ্রাম জেলার। রেজিস্ট্রেশন (নিবন্ধন) নাই। গাড়ি চালাই অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী এলাকায়। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন না থাকায় থানার ক্যাশিয়ারকে মাসে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

এ ছাড়া শনিবার দুপুরে এবং গতকাল মঙ্গলবার সকালে অক্সিজেন এলাকায় নিবন্ধন থাকা সিএনজি অটোরিকশার কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হয়। চাঁদার ‘টোকেন’ ও ‘রসিদ’ দেখিয়ে তাঁরা জানান, এমন কোনো সিএনজি অটোরিকশা (চট্টগ্রাম জেলায় চলাচলকারী) নেই যে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে না। গ্রামের গাড়িকে গ্রামেও চাঁদা দিতে হয়। শহরে যাত্রী নিয়ে ঢুকলে আবার চাঁদা দিতে হয়। আর গ্রাম থেকে শহরের কয়েকটি রুটে চললে আবার টাকা দিতে হয়।
ওই চালকদের ভাষ্য, অক্সিজেন থেকে হাটহাজারী-নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি সড়কে আড়াই থেকে তিন হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ির জন্য মাসে গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাপ্তাই রাস্তার মোড় এলাকায় চট্টগ্রাম জেলার সিএনজি অটোরিকশাগুলো থেকে ‘ওয়েবিল’ বাবদ প্রতিটি থেকে ১০ থেকে ২০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া নগরের প্রবেশপথ কালুরঘাট, কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু, সিটি গেট, জেলার আনোয়ারা চাতরি চৌমুহনীসহ ঘাটে ঘাটে সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলায় সরকার নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। আর নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে ২৮ থেকে ৩০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে অর্ধলক্ষাধিক সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এসব সিএনজি অটোরিকশার বৈধ ও অবৈধ মালিক-শ্রমিক সংগঠন, ট্রাফিক ও থানা পুলিশ, ক্ষমতাসীন দলের এলাকাভিত্তিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে একাধিক পক্ষ ঘাটে ঘাটে চাঁদা তুলছে।
নগর ট্রাফিক পুলিশের এক পরিদর্শক, মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাঁদাবাজির টোকেন ও রসিদ কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে।

এতে দেখা গেছে, জেলায় চলাচলরত গাড়িগুলো নগরের আংশিক এলাকায় চলাচল করলে ওয়েবিল বাবদ প্রতিদিন ২০ টাকা নেওয়ার পর রসিদ দেওয়া হয়। অক্সিজেন মোড়ে ‘উত্তর চট্টগ্রাম অটোরিকশা চালক সমন্বয় পরিষদ’-এর নামে রসিদে এই টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর টোকেনগুলো সিএনজি অটোরিকশার সামনে গ্লাসে সাঁটানো রয়েছে। প্রতিটির দাম ৩৩০ টাকা। চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি (সিএনজি) টেম্পো ড্রাইভার্স ও সহকারী ইউনিয়নের স্টিকারসংবলিত টোকেনে এই টাকা নেওয়া হচ্ছে।
একাধিক চালক জানান, টোকেনের মাধ্যমে প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে মাসে যে ৩৩০ টাকা নেওয়া হয় তার থেকে পুলিশকেও নাকি দেওয়া হচ্ছে। টাকা না দিলে এই রুটে (অক্সিজেন থেকে নাজিরহাট-খাগড়াছড়ি সড়ক) গাড়ি চালাতে দেয় না ট্রাফিক পুলিশ। ৩৩০ টাকা দিয়ে গাড়িতে টোকেন লাগানো থাকলে তা দেখে তারা আর হয়রানি করে না।

সিএনজি অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের একাধিক নেতা জানান, সিএনজি অটোরিকশা ঘিরে আনোয়ারা, পটিয়া, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, বোয়ালখালী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি চাঁদাবাজি হয়। ওই পাঁচ উপজেলায় কিছু নামসর্বস্ব সংগঠনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানা ও ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে।
এর মধ্যে আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনী এলাকা দিয়ে পাশের বাঁশখালী, পটিয়া ও চকরিয়ার পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকার সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করে। চাতরী চৌমুহনী এলাকায় গাড়িপ্রতি মাসে ২০০ টাকার টোকেনে সেগুলো চলছে। স্থানীয় ট্রাফিক পুলিশের টোকেনে এই চাঁদাবাজি হচ্ছে। টোকেন না থাকলে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সব গাড়িই পুলিশের হয়রানির শিকার হয়।
এ ছাড়া বোয়ালখালী থানা এলাকায় প্রতিটি সিএনজি অটোরিকশা থেকে ৩০০ টাকার টোকেন, নগরের মইজ্জারটেক এলাকায় পটিয়া, আনোয়ারাসহ দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা গ্রামের সিএনজি অটোরিকশাগুলো থেকে ১৫০ টাকা করে নিচ্ছে মালিক সংগঠন।
আর নগরের অক্সিজেন ও বায়েজিদ এলাকায় ৩৫০ থেকে ৪০০ গাড়ি চলাচল করছে নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক মো. নূরে আলম সিদ্দিকীর টোকেনে। ওই টোকেনে নির্দিষ্ট এলাকায় চলাচল করতে পারবে। এ জন্য সড়ক ও এলাকাভেদে মালিক ও চালক থেকে ৬০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

শ্রমিক নেতারা জানান, ট্রাফিক বা থানা পুলিশ কেউ আটকালে ওই টোকেন (মো. নূরে আলম সিদ্দিকীর দুটি মোবাইল নম্বর রয়েছে সেখানে) দেখানো হলে সবাই ছেড়ে দেয়। শুধু ওই পুলিশ কর্মকর্তা নন, এভাবে নগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন ট্রাফিক ও থানা পুলিশের কর্মকর্তার টোকেনে বেশ কিছু সিএনজি চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব এলাকার বাইরে চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলায় ৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা এভাবেই কখনো রসিদে কখনো টোকেনে আবার কখনো নগদ চাঁদায় চলাচল করছে। মালিক ও চালকরা বাধ্য হয়ে নির্ধারিত হারে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিয়ে আসছে। এসব গাড়ি থেকে মাসে কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি চলছে।
এদিকে চট্টগ্রাম জেলায় নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশার চেয়ে অনিবন্ধিতই বেশি। প্রায় ৩০ হাজার অনিবন্ধিত অটোরিকশা টোকেন ও রসিদ দিয়ে চলাচল করছে। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ৩০ হাজার গাড়ির নিবন্ধন হলে সরকার এককালীন অর্ধশত কোটি টাকার রাজস্ব পেত। এ ছাড়া প্রতিবছর নবায়ন ফি বাবদ ২১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হতো বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

নিজের নামে ‘টোকেন’ দিয়ে সাড়ে তিন শ থেকে চার শ সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক মো. নূরে আলম সিদ্দিকী গতকাল সন্ধ্যায় দাবি করেন, ‘আমার নামে কোনো টোকেন নেই। আমার নাম ব্যবহার করে কেউ এই কাজ করতে পারে। অক্সিজেন এলাকায় বিভিন্ন সংগঠনের নামে সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। আমি সব সময় চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে। এ কারণে কেউ আমার নামে অপপ্রচার চালাতে পারে। ’
চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি (সিএনজি) টেম্পো ড্রাইভার্স ও সহকারী ইউনিয়নের এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের সদস্য আছে ছয়-সাত শ। প্রত্যেকে মাসিক ৩৩০ টাকা করে দিচ্ছে। এই টাকা শ্রমিকদের তহবিলে আছে। তাদের কল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে। ’

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সদস্য মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলায় সিএনজি অটোরিকশা বৈধ গাড়ির চেয়ে অবৈধ বেশি। প্রায় ২৫ হাজার নিবন্ধিত থাকলেও অনিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে ২৮-৩০ হাজার। আমরা শুনেছি, থানা ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করে বেশির ভাগ গাড়ি চলাচল করছে। এ ছাড়া গাড়িগুলো থেকে বিভিন্নভাবে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে নানা মালিক শ্রমিক সংগঠনের নামে। অবৈধ গাড়িগুলো থেকে পুলিশ টাকা না নিলে তা সড়কে কিভাবে চলছে?’
চট্টগ্রা

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/12/27/582357