২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১৬

ভারতে পাচার হচ্ছে স্বর্ণ ও হুন্ডির টাকা

দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ধ্বংস করে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানি চক্র বেনাপোল সীমান্তের অবৈধ পথ এবং পাসপোর্ট যাত্রীর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ ভারতে পাচার করছে। এপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ বেনাপোলে নিয়োজিত বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারী জোরদার করে স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধ করা উচিত। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যৎসামান্য পুলিশ, বিজিবি ও কাস্টমস সদস্যরা আটক করলেও সিংহভাগ চলে যাচ্ছে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে।

বেনাপোল সীমান্ত থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। আর যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো। আর এ কারণে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চোরাচালানি চক্র। এ চক্রটি প্রায় প্রতিদিন সোনা ও হুন্ডির টাকা পাচার অব্যাহত রেখেছে। সাথে মাদকও। ফলে বেনাপোল সীমান্ত এখন চোরাচালানিদের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিণত হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে এ চক্রের সদস্যদের আটক করা হলেও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে রাঘব-বোয়ালরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও করিডোর থাকায় চোরাচালানিরা সোনা পাচারে এ পথ ব্যবহার করছে। সোনা যাদের কাছে পাওয়া যায়, বিজিবি কেবল তাদেরই আটক করে থাকে। পরে সরকারের অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা তদন্ত করে দেখেন। সীমান্তের একটি সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৪৩ কেজি সোনা আটক হলেও প্রতিদিন পাসপোর্ট যাত্রী এবং চোরাচালানিদের মাধ্যমে কেজি কেজি সোনা ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা থেকে চার বার হাত বদল হয়ে সোনা পাচার হয় ভারতে। প্রথমতঃ ঢাকা থেকে ট্রেন অথবা বাসে একটি গ্রুপ সোনা নিয়ে বেনাপোলে আসে। পরিবহন কাউন্টার অথবা তাদের নির্ধারিতস্থানে স্বর্ণের চালানটি বদল হয় স্থানীয় এজেন্টদের হাতে। স্থানীয় এজেন্টের বহনকারীরা স্বর্ণের চালানটি নিয়ে চলে যায় গাতীপাড়া, দৌলতপুর, পুটখালী, ঘিবা সীমান্তের কোন বাড়িতে। সেখান থেকে হাত বদল হয় শুধুমাত্র সীমান্ত পার করে ভারতীয় এজেন্টের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত।

বিজিবি এবং কাস্টমস সূত্র মতে, গত ১০ মাসে প্রায় ৪৩ কেজি স্বর্ণ ও পৌণে দুই কোটি হুন্ডির টাকা উদ্ধার করেছে বিজিবি ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এসময়ে ভারতে পাচারের সময় ৩৭২ পিস বা প্রায় ৪৩ কেজি স্বর্ণসহ ৩৬ জন পাচারকারীকে আটকের তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর বেনাপোলের পুটখালী গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে ইমরান হোসেন ও রেজাউল ইসলামের ছেলে বিল্লাল হোসেনকে ৪ কেজি ২৮০ গ্রাম ওজনের ২৬ পিস সোনার বিস্কুটসহ বেনাপোল বন্দরের সামনে থেকে আটক করে বেনাপোল আইসিপি বিজিবি সদস্যরা। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় পাসপোর্টযাত্রী ধীমান সরকার, নিতীষ সিং ও মহেষ লাল শাহকে ১৭ পিস সোনার বারসহ আটক করে কাষ্টমসের শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা।
১ ডিসেম্বর ভারতীয় পাসপোর্টযাত্রী উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ইকবালপুর থানার খিদিরপুর গ্রামের নূরুল হকের ছেলে নসরুল হক ও দিল্লীর উত্তম নগর এলাকার মেহেন্দার বর্মার ছেলে সঞ্জীব বর্মাকে ২০ পিস সোনার বিস্কুটসহ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। এর আগে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি দৌলতপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা বড় আঁচড়া গ্রামের বজলুর রহমানকে ১৪ পিস স্বর্ণের বিস্কুটসহ আটক করে।
৪ মার্চ দৌলতপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা গাতীপাড়া গ্রামের টিটু বিশ্বাসকে ২০ পিস স্বর্ণসহ আটক করে। বেনাপোল বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ১ এপ্রিল শামীম হোসেন এবং হোসেন আলী নামে ২ স্বর্ণ চোরাচালানিকে ১৫টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে। ২৭ মে বেনাপোল সীমান্তের দৌলতপুর ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা ২ কেজি ৩শ’ গ্রাম ওজনের ২০টি স্বর্ণের বিস্কুটসহ বড়আঁচড়া গ্রামের মনিরুজ্জামানকে আটক করে।
পুটখালী ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা ৩০ মে মনির হোসেনকে ১০ পিস স্বর্ণের বিস্কুটসহ হাতেনাতে আটক করে। ৫ জুন পুটখালী বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা বাবুল হোসেনকে ১০টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে।
বেনাপোলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে স্বর্ণ পাচারের সময় স্বর্ণসহ পাচারকারীরা বিজিবির হাতে আটক হওয়ার কারণে কৌশল বদল করেছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানীরা। চোরাই পথে স্বর্ণ ভারতে পাচার না করে এবার তারা পাসপোর্ট যাত্রীদের মাধ্যমে বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে পাচার করছে স্বর্ণ।
পাসপোর্ট যাত্রীদের মাধ্যমে স্বর্ণ পাচারের সময় ১১ জুলাই নারায়গঞ্জের আবু সালামকে বেনাপোলের ওপারে ভারতের হরিদসপুর আইসিপির কাস্টমস সদস্যরা ২০টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে। যার ওজন প্রায় দুই কেজি ৩শ’ গ্রাম। বাংলাদেশী পাসপোর্ট যাত্রী ভারতে সোনাসহ আটকের পর বেনাপোল চেকপোস্টের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। বর্হিগমন চেক পয়েন্টের স্ক্যানিং মেশিনটি দ্রুত মেরামত করে চালু করে। তার পরের দিন ১২ জুলাই বেনাপোল কাস্টমস হাউসের শুল্ক গোয়েন্দা সদস্যরা চেকপোস্ট এলাকা থেকে ভারতগামী পাসপোর্ট যাত্রী পারভেজকে ৭টি স্বর্ণের বিস্কুটসহ আটক করে। জুতার সোলের মধ্যে লুকিয়ে এ সোনা পাচার করা হচ্ছিল বলে শুল্ক গোয়েন্দারা জানায়। ১৪ জুলাই পাসপোর্ট যাত্রী জালাল আহমেদ সেলিমকে ৫ পিস স্বর্ণের বিস্কুটসহ চেকপোস্ট কাস্টমস এলাকা থেকে শুল্ক গোয়েন্দারা আটক করে। ১৫ জুলাই ২ কেজি ৭৫০ গ্রাম ওজনের ১১ পিস স্বর্ণের বারসহ পাসপোর্ট যাত্রী ঢাকার ওয়ারী এলাকার রুখসানা বেগমকে শুল্ক গোয়েন্দারা আটক করে।
১৭ জুলাই এক কেজি ২৫০ গ্রাম ওজনের ৫ পিস স্বর্ণের বারসহ মুন্সিগঞ্জ জেলার টুঙ্গিবাড়ী থানার মৃত সামসুল হকের ছেলে সেলিমকে আটক করে কাস্টমসের সদস্যরা। ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জের হারুন আল কবির ও আরিফুল হককে চারটি সোনার বারসহ আটক করে চেকপোস্ট কাস্টমসের সদস্যরা। ২৮ জুলাই একজন ভারতীয় ও একজন বাংলাদেশীকে চারটি সোনার বারসহ আটক করে ভারতের পেট্রোপোল কাস্টমস সদস্যরা।
৮ আগস্ট ৪ কেজি ওজনের ৩৫ পিস স্বর্ণের বারসহ শার্শা উপজেলার নুর ইসলামের ছেলে আব্দুল মমিনকে আটক করে পুটখালী বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা। ১০ আগস্ট এক কেজি ২শ’ গ্রাম ওজনের ১২ পিস স্বর্ণের বার সহ আশিক নামে একজনকে আটক করে বেনাপোল চেকপোস্ট বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা। ১৮ আগস্ট এক কেজি ৪শ’ গ্রাম ওজনের ১৪ পিস স্বর্ণের বারসহ কদর আলী নামে একজন পাচারকারীকে আটক করে বেনাপোল সদর ক্যাম্পের সদস্যরা।

৫ অক্টোবর শরিয়তপুরের সুজন মিয়া ও মাদারীপুরের জনি মিয়াকে আটটি সোনার বারসহ আটক করে বেনাপোল কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দা সদস্যরা। ৬ অক্টোবর পাসপোর্ট যাত্রী ঢাকার কদমতলীর মিজানুর রহমান ও কুমিল্লার চান্দিনার মাহবুব আলমকে ৭ পিস সোনার বারসহ আটক করে বেনাপোল কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। ৯ অক্টোবর পাসপোর্ট যাত্রী কুমিল্লার মুরাদনগর এলাকার মকবুল হোসেনের ছেলে মাইনউদ্দিনকে ১০টি সোনারসহ আটক করে বেনাপোল কাস্টমসের শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। ১০ অক্টোবর যশোর সদরের ডুমদিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের ছেলে রিপনকে ১০টি সোনার বারসহ আটক করে বেনাপোল পুটখালী ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা।
১৭ অক্টোবর ১৮ পিস সোনার বারসহ শ্রবন নামে উত্তর ২৪ পরগনার চড়ূইগাছি এলাকার এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করে বেনাপোল আইসিপি বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা। ২৯ নভেম্বর শরিয়তপুর জেলার জাজিরা থানার নওডুবা গ্রামের ইব্রাহিমের ছেলে ইলিয়াস ও গোপালগঞ্জ সদরের ঘোষেরচর এলাকার জাহাঙ্গীরের ছেলে মহসিনকে ১০ টি সোনারসহ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা।
সূত্র জানায়, স্বর্ণ পাচারকারী চক্রের সদস্যরা বিজিবি’র হাতে আটক হওয়ায় চক্রটি নতুন নতুন কৌশলে রাতে ও দিনে বেনাপোল বাজার থেকে সোনা নিয়ে সীমান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়া পুরুষ ও মহিলা পাসপোর্ট যাত্রীরা ঢাকা থেকে সোনা নিয়ে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন।
বেনাপোল কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দার ডেপুটি কমিশনার আব্দুস সাদেক বলেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়ে আমরা সোনাসহ পাচারকারীদের আটক করে থাকি পাশাপাশি আমাদের গোয়েন্দারা সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখেন, যাতে দেশের সোনা পাচার হয়ে বাইরে না যায়।

বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি অপূর্ব হাসান জানান, সোনা পাচারের কোন তথ্য পেলে তা তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে তা আটক করে। বেনাপোল পোর্ট থানা বিগত দিনগুলোতে সোনার বড় বড় চালান আটক করেছে।
এ ব্যাপারে যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফুল হক জানান, ভারতে সোনার চাহিদা বেশি থাকায় আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারী চক্রের সদস্যরা এখন ভারতে পাচার করছে। তিনি জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানপথে সোনা আসার পর শুল্ক কর্মকর্তাদের নজর এড়িয়ে বেশ কিছু চালান দেশের ভেতরে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সীমান্তের বৈধপথে ও অবৈধপথে বিভিন্ন ভাবে ভারতে সোনা পাচার হচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/312760