২৭ ডিসেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১২

আসল টাকা, নকল টাকা

আলমগীর মহিউদ্দিন :
টাকা নিয়ে নাটক, নোভেল এবং গল্পের শেষ নেই। সব আলোচনায় টাকাটা আসল নাকি নকল, এই প্রশ্নটা থাকবে। খবরের কাগজে মাঝে মধ্যে সরকারি বিজ্ঞাপনে ছাপা হয় এ বিষয়ের সতর্কবাণী। টাকার আয়তন, নকশা, কাগজ ইত্যাদির বর্ণনা দিয়ে জনগণকে সতর্ক করা হয় নকল টাকা সম্পর্কে।
এটা এক অতি পরিচিত দৃশ্য। কোনো কিছু কেনাকাটা করে দোকানিকে একটি ৫০০ টাকার নোট দেয়া হলো। দোকানি সেটি উল্টেপাল্টে স্পর্শ করে যাচাই করে নেবে। ফলে নকল টাকা চালু রাখা দুরূহ ব্যাপার।
কিন্তু এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে নকল এবং আসল টাকা নিয়ে। প্রশ্নটা হলো, বিশ্ব অর্থনীতি কোন টাকা দিয়ে চলে? এর জবাবে এক নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। অদৃশ্য টাকা, যা নকল টাকার মতোই, তবে তা সবাই গ্রহণ করে। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছেন ইলেকট্রনিক মানি এবং এটা বিশ্বের অর্থনীতির এখন প্রধান বাহন। এটা অনেকাংশে শুধু কাগজের পাতায় অঙ্কের মাঝে বাস করে। কেন? জবাব কয়েকটি। টাকা আদান-প্রদানের সুবিধা এই ইলেকট্রনিক টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে, তা অনস্বীকার্য। এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে ব্যাংক।
ব্যাংকের অনেক সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছেÑ তারা ‘শূন্য থেকে’ টাকা তৈরি করছে এবং বাহ্যিক টাকার একাংশই মাত্র তারা ব্যবহার করে, বলেছেন মার্টিন উলফ ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অন ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।

সবাই জানে, টাকা ছাপানোর অধিকার শুধু সরকারের। এ জন্যই প্রতিটি নোটে লেখা থাকে ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বে প্রবর্তিত। গভর্নর (বাংলাদেশ ব্যাংক)। এ প্রতিশ্রুতিটি পাঁচ টাকা নোট পর্যন্ত লেখা থাকে এবং তা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। তবে এক বা দুই টাকার নোট এবং মুদ্রায় এই প্রতিশ্রুতি থাকে না। কারণ সেগুলোর জন্য সরকার সরাসরি দায়ী এবং সরকারের অর্থসচিব এর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ব্যাংকগুলো সবার অজান্তে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে এই টাকা তৈরি করছে। অর্থব্যবস্থার প্রচলিত নিয়ম অনুসারে প্রতিটি টাকার পেছনে সমমূল্যের স্বর্ণ বা তেমন মূল্যবান ধাতু প্রদানের অঙ্গীকার থাকে। তাই বলা হয়, ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে’। প্রশ্ন উঠতে পারে, তা কি হয় অথবা সম্ভব?
ব্যাংক কেমন করে টাকা তৈরি করে? ‘পজিটিভ মানি’ আন্দোলনের নেতা বেন ডাইসন এর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। এক লাইনের এই বর্ণনায় বলা হয়, যখনই কেউ কোনো ব্যাংক থেকে কোনো ঋণের আবেদনে বলে ‘টাকাটা তার অ্যাকাউন্টে দিয়ে দিতে, তখন ব্যাংক টাকার অঙ্কটা অ্যাকাউন্টে লিখে দেয়।’ তখন সে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে খরচ করতে পারে। অর্থাৎ ব্যাংক ‘নিজে টাকা তৈরি করে’। ডাইসন বলেছেন, ‘অথচ প্রচলিত আইন হলো, কেউ টাকা তৈরি করতে পারবে না।’ যদি একটা ১০ টাকার নোটও ছাপায়, তাহলে এই আইনে শাস্তি দেয়া হয়। অথচ ব্যাংক যখন সেই টাকা অবাধে তৈরি করছে, তাকে কেউ নিবৃত্ত করতে পারছে না। এ টাকা প্রচলিত আইন অনুসারে নকল বা বেআইনি হওয়া উচিত। তা না হয়ে বরং বিশ্বব্যাপী এই পদ্ধতির টাকাই রাজত্ব করছে। অবশ্য ব্যাংক বলছে, যখনই কোনো ঋণ দেয়া হলো, তখনই ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে একটা পাওনা জমা হলো এবং এভাবে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে এবং এর পরিবর্তে ব্যাংক টাকা নির্মাণ করে নিজের সম্পদের হিসাব করতে থাকে।

ডাইসন মার্কিন অর্থনীতির আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, অপরাধীচক্র প্রতি বছর যে ভুয়া ডলার ছাপায়, তার প্রায় আড়াই বিলিয়ন ধরা পড়ে; কিন্তু সেই সময়ে ব্যাংকগুলো ১০০ বিলিয়ন নতুন ডলার বা পাউন্ড তৈরি করে। আইন অনুসারে এগুলোও ভুয়া হওয়ার কথা, কিন্তু এ বিষয় নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না। ব্যাংকগুলো এই অর্থ তৈরি করে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সুদ নিচ্ছে, যা তাদের সম্পদ বলে রক্ষা করা হয়। অপর দিকে সাধারণ মানুষকে সুদের পাহাড়ে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে।
কাগুজে টাকার জন্ম ও ব্যবহার নিয়ে ডাইসন এক চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল বা টরি দলের প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট পিল (১৮৪৪) লক্ষ করলেন, মানুষ ধাতুর (স্বর্ণ, রুপা ও তামা) মুদ্রা নিয়ে বিব্রত। তখন কাগুজে টাকার প্রচলন করা হলো এবং তাৎক্ষণিকভাবে এটা সবার কাছে প্রিয় হয়ে পড়ল। এই কাগুজে টাকাগুলো তখন সব ব্যাংকেই ছাপানো হতো। স্যার পিল ব্যাংক চার্টার অ্যাক্ট, ১৮৪৪ নামে এক আইন জারি করে ব্যাংকের এই কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে, টাকা ছাপানোর সব অধিকার ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কাছে ন্যস্ত করেন। তখন থেকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সব নোট ছাপাচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমে বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় সরকারি ব্যাংক এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে।

এর সুফল হলোÑ সরকার মুদ্রাস্ফীতিকে ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর কুফল হলো, যদি সরকার জনবিরোধী ও দুর্নীতিবাজ হয়, তবে তারা প্রচুর টাকা ছেপে এবং তা কুক্ষিগত করে দ্রুত ধনবান হয়ে যাবে। তবে কাগুজে টাকার স্ফীতি নানা কারণে বাড়ছে এবং এর সাথে দুর্নীতির নানা আকার ও প্রকার।
ডাইসনের একটি তথ্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাজনীতিবিদ এবং ব্যাংকÑ উভয়েই এই টাকা তৈরির সাথে জড়িত। যদি আইনের কড়া নজরদারিতে না থাকে, তাহলে তারা জনগণকে ঋণের পাহাড়ের নিচে ফেলে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করবে। অতএব, এই ক্ষমতা তাদের কাছ থেকে নিয়ে জনগণ সম্পৃক্ত ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অবশ্য কাজটি খুবই জটিল এবং দুরূহ। তবে জনগণকে রক্ষার এটি একমাত্র পথ।
কাগুজে টাকা এবং এখন ইলেকট্রনিক টাকা কেন আসল ধাতুনির্ভর টাকাকে বদলে দিলো? এর বহু কারণের মধ্যে একটি হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চল্লিশের দশকে ঘোষণা করল, বিশ্বে রিজার্ভ হবে শুধু ডলার। কোনো ধাতুর প্রয়োজন নেই। আর ডলারের পেছনে স্বর্ণেরও প্রয়োজন নেই। সবাই মেনে নিল, কারণ যুক্তরাষ্ট্র সুপার পাওয়ার।
এ দিকে, বিশ্বে কত স্বর্ণ আছে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে সব সময়। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল এর হিসাব রাখে। তাদের মতে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৮৭ হাজার টন স্বর্ণ খনি থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতি বছর দুই হাজার ৫০০ টন উত্তোলিত হচ্ছে। কাউন্সিলের মতে, এর মূল্য ৭.৫ ট্রিলিয়ন (এক ট্রিলিয়ন ১০০ কোটি কোটি) ডলার। তাদের মতে, সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (৮১৩৩ টন), যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৭৪.৯ শতাংশ। এরপর জার্মানি (৩৩৭৩.৬ টন), আইএমএফ (২৮১৪ টন), ইতালি (২৪৫১.৮ টন), ফ্রান্স (২৪৩৫ টন), চীন (১৮৪২.৬ টন), রাশিয়া (১৮০১.২ টন), সুইজারল্যান্ড (১০৪০ টন), জাপান (৭৬৫.২ টন), নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড (৬১২.৫ টন), ভারত (৫৫৭.৮ টন), তুরস্ক (৫২৫.৮ টন), ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (৫০৪.৮ টন), তাইওয়ান (৪২৩.৬ টন), পর্তুগাল (৩৮২.৫ টন), সৌদি আরব (৩২২.৯ টন), ব্রিটেন (৩১০.৩ টন), কাজাখস্তান ২৯১.৯ টন), লেবানন (২৮৬.৮ টন) এবং ২০ নম্বরে স্পেন (২৮১.৬ টন)। বিশ্বের এই ২০ দেশে স্বর্ণের মজুদ সর্বোচ্চ। তবে উল্লেখযোগ্য, তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বর্ণের মজুদ থেকে বেশি। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুদ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৭৪.৯ শতাংশ। এভাবে জার্মানি (৬৮.৯ শতাংশ), ইতালি (৬৭.৩ শতাংশ), ফ্রান্স (৬৪.৯ শতাংশ ), চীন (২.৩ শতাংশ), রাশিয়া (১৭.৩ শতাংশ), সুইজারল্যান্ড (৫.৩ শতাংশ)।

এই জটিল হিসাবের পেছনে সরকার কাগুজে টাকা ছাপতে থাকলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সাথে তা যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তখনই মুদ্রাস্ফীতির সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। তবে মজার কথা হলো, এতে সেই নকল বা ইলেকট্রনিক টাকার অবদান বেশি হলেও সে প্রসঙ্গ সামনে আসে কম। কারণ, বিশ্বের অর্থনীতির প্রধান অবস্থান এই নকল টাকার ওপর। ডাইসন তাই পরামর্শ দিয়েছেন, ব্যাংকের ইলেকট্রনিক টাকা তৈরির ক্ষমতাকে কঠোরভাবে নজর ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে অর্থনৈতিক স্বস্তির জন্য।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/279850