২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১২:০৫

আল কুরআনে সীরাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

-অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামী বিশ্বকোষে ‘সিরাত’-এর বেশ কিছু অর্থ উল্লেখ করেছে। তম্মধ্যে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত; সম্প্রসারিত অর্থে বীরষদের কীর্তির বর্ণনা অর্থটি উল্লেখযোগ্য। কুরআনের বিভিন্ন সূরায় রাসূল (সা.) সম্বন্ধে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য আছে। অন্যদিকে হাদীস শরীফে রাসূল (সা.)-এর জীবনের সবদিক ও বিভাগের খুঁটিনাটি বর্ণিত হয়েছে।

‘কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র’, হজরত আয়েশা (রা.)। কুরআন মাজীদের আয়াতে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনচরিত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কিত আয়াতগুলো নিবিড়ভাবে খুঁজে বের করলে রাসূলের সীরাত বুঝতে মোটেও অসুবিধা হবে না। আল কুরআনে বর্ণিত রাসূলের সীরাত সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় কোনো সন্দেহ নেই। এরকম একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা পাঠক পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরা হলো-

১. নৈতিকতার অতি উচ্চমর্যাদায় সমাসীন
নিঃসন্দেহে তুমি নৈতিকতার অতি উচ্চমর্যাদায় সমাসীন? (সূরা কলম : ৪)। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) নৈতিক চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর অধিষ্ঠিত। তাই তিনি আল্লাহর বান্দাদের হিদায়াতের কাজে এত দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। একজন দুর্বল নৈতিক চরিত্রের মানুষ এ কাজ করতে সক্ষম হতো না। অন্যটি হলো, কাফেররা তার প্রতি পাগল হওয়ার যে অপবাদ আরোপ করেছে তা মিথ্যা হওয়ার আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ তার উন্নত নৈতিক চরিত্র। কারণ উন্নত নৈতিক চরিত্র ও মস্তিষ্ক বিকৃতি একসাথে একই ব্যক্তির মধ্যে থাকতে পারে না। যার বুদ্ধি-বিবেক ও চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে এবং মেজাজে সমতা নেই সেই পাগল। পক্ষান্তরে মানুষের উন্নত নৈতিক চরিত্র প্রমাণ করে যে, তার মস্তিষ্ক ও বিবেক-বুদ্ধি ঠিক আছে এবং সে সুস্থ ও স্বাভাবিক। তার মন-মানস ও মেজাজ অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নৈতিক চরিত্র কেমন তা মক্কার প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষ চিন্তা করতে বাধ্য হবে যে, তারা কতই নির্লজ্জ। নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে এত উন্নত একজন মানুষকে তারা পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদের এ অর্থহীন কথাবার্তা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য নয় বরং তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। কারণ শত্রুতার আক্রোশে উন্মাত্ত হয়ে তারা তাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলেছিল, যা কোনো বিবেকবান ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না। এ যুগের জ্ঞান-গবেষণার দাবিদারদের ব্যাপারও ঠিক তাই। তারাও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি রোগগ্রস্ত ও বিকৃত মস্তিষ্ক হওয়ার অপবাদ আরোপ করছে। দুনিয়ার সব জায়গায় কুরআন শরীফ পাওয়া যায় এবং নবী (সা.)-এর জীবন বৃত্তান্তও সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে। যে কোনো লোক তা অধ্যয়ন করলেই বুঝতে পারবে, যে এ অনুপম গ্রন্থ পেশকারী এবং এরূপ উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী মানুষটিকে মানসিক রোগী বলে আখ্যায়িত করে তারা শত্রুতার অন্ধ আবেগে আক্রান্ত হয়ে কি ধরনের অর্থহীন ও হাস্যকর প্রলাপ বকে চলেছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন হজরত আয়েশা (রা.)। তিনি বলেছেন, অকানা কুল্লুকুহুল কুরআন- কুরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র। ইমাম আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, দারেমী ও ইবনে জারীর সামান্য কিছু শাব্দিক তারতম্যসহ তাঁর এ বাণীটি বিভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন। এর মানে রাসূলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার সামনে শুধু কুরআনের শিক্ষাই পেশ করেননি। বরং তিনি নিজেকে তার জীবন্ত নমুনা হিসেবে পেশ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

কুরআনে যেসব নির্দেশ দেয়া হয়েছে সবার আগে তিনি নিজে সে মোতাবিক কাজ করেছেন। এতে যেসব বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে, তিনি নিজে তা সবার আগে বর্জন করেছেন। কুরআন মজীদে যে নৈতিক গুণাবলীকে মর্যাদার কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেসব গুণে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে বেশি গুণান্বিত। আল কুরআন মজীদে যেসব বিষয়কে অপছন্দনীয় আখ্যায়িত করা হয়েছে তিনি নিজে ছিলেন তা থেকে সবচেয়ে বেশি মুক্ত। আরেকটি বর্ণনায় হজরত আয়েশা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো কোনো খাদেমকে মারেননি, কোনো নারীর গায়ে হাত তোলেননি, জিহাদের ক্ষেত্র ছাড়া নিজ হাতে কখনো কাউকে হত্যা করেননি।

তাঁকে কেউ কষ্ট দিয়ে থাকলে তিনি কখনো তার প্রতিশোধ নেননি। কেবল আল্লাহর হারাম করা বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তার শাস্তি দিয়েছেন। তাঁর নীতি ছিল, কোনো দু’টি বিষয়ের একটি গ্রহণ করতে হলে তা যদি গোনাহের কাজ না হতো, তাহলে তিনি সহজতর বিষয়টি গ্রহণ করতেন। গোনাহের কাজ থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি দূরে থাকতেন। (মুসনাদে আহমাদ)। হজরত আনাস বর্ণনা করেছেন, আমি দশ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। আমার কোনো কাজ সম্পর্কে তিনি কখনো উহ! শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। আমার কোনো কাজ দেখে কখনো বলেননি, তুমি এ কাজ করলে কেন? কিংবা কাজ না করলে কখনো বলেননি, তুমি এ কাজ করলে না কেন? (বুখারী ও মুসলিম)। সীরাতে ইবনে হিশাম সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বাংলা অনুবাদ পৃষ্ঠা-১৯২ দেখুন। (অনুবাদক)।

২. তিনি কারোর পিতা নন, তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী
(হে লোকেরা!) মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে কারোর পিতা নন, কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী আর আল্লাহ সব জিনিসের জ্ঞান রাখেন? (সূরা আহযাব : ৪০)। এখানে তিনটি বক্তব্য- ১. তিনি কারোর পিতা নন, ২. তিনি আল্লাহর রাসূল এবং ৩. তিনি শেষ নবী।

বিরোধীদের প্রথম অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের পুত্রবধূকে বিয়ে করেন, অথচ তাঁর নিজের শরীয়াতেও পুত্রের স্ত্রী পিতার জন্য হারাম। এর জবাবে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নন।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তির তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হয়েছে তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর পুত্রই ছিলেন না, কাজেই তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা হারাম হবে কেন? ‘কিন্তু তিনি আল্লাহর রাসূল।’ অর্থাৎ রাসূল হওয়ার কারণে তাঁর ওপর এ দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয়েছিল যে তোমাদের রসম-রেওয়াজ যে হালাল জিনিসটিকে অযথা হারাম গণ্য করে রেখেছে সে ব্যাপারে সবরকমের স্বার্থপ্রীতির তিনি অবসান ঘটিয়ে দেবেন এবং তার হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশই রাখবে না।
‘তিনি শেষ নবী’, অর্থাৎ যদি কোনো আইন ও সামাজিক সংস্কার তাঁর আমলে প্রবর্তিত না হয়ে থাকে তাহলে তাঁর পরে

আগমনকারী নবী তার প্রবর্তন করতে পারতেন, কিন্তু তাঁর পরে আর কোনো রাসূল তো দূরের কথা কোনো নবীই আসবেন না। কাজেই তিনি নিজেই জাহেলিয়াতের এ রসমটির মূলোচ্ছেদ করে যাবেন, এটা আরো অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। ‘আল্লাহ প্রত্যেটি বিষয়ের জ্ঞান রাখেন।’ অর্থাৎ আল্লাহ জানেন, এখন আর তাঁর পক্ষ থেকে কোনো নবী আসবেন না, কাজেই নিজের শেষ নবীর মাধ্যমে তিনি এ রসমটিকে উৎখাত করেন।

৩. আল্লাহর রাসূল সকল মানুষের জন্য
‘হে নবী! বলে দাও, হে মানবজাতি, আমি হচ্ছি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসূল।’ (সূরা আল আ’রাফ : ১৫৮)। তোমাকে কেবল এ শহর ও এ যুগের লোকদের জন্য নয়, বরং সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জন্য তোমাকে চিরন্তন নবী হিসেবে পাঠান হয়েছে। কিন্তু তোমার এ সমকালীন স্বদেশীয় লোকেরা তোমার মর্যাদা বুঝে না। কত বড় মহান সত্তাকে তাদের মধ্যে পাঠান হয়েছে সে ব্যাপারে কোনো অনুভূতিই তাদের নেই।

নবী করীম (সা.)-কে কেবল তাঁর নিজের দেশ বা যুগের জন্য নয় বরং কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে, এ কথা কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে, ‘আর আমার প্রতি এ কুরআন অহির সাহায্যে পাঠানো হয়েছে যাতে এর মাধ্যমে আমি তোমাদের এবং যার কাছে এ বাণী পৌঁছে যায় তাকেই সতর্ক করে দেই। (আলে আন’আম : ১৫৭)।
‘আর হে নবী! আমি পাঠিয়েছি তোমাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্যই রহমত হিসেবে।’ (আল আম্বিয়া : ১০৭)। ‘বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি যিনি তার বান্দার ওপর ফুরকান নাজিল করেছেন যাতে সে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সতর্ককারীতে পরিণত হয়।’ (আল ফুরকান, ১)। নবী (সা.) নিজেই এই একই বক্তব্য বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্নভাবে পেশ করেছেন। যেমন- ‘আমাকে সাদা-কালো সবার কাছে পাঠান হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু মুসা আশ’আরী বর্ণিত)।

‘আমাকে ব্যাপকভাবে সমস্ত মানুষের কাছে পাঠান হয়েছে। অথচ আমার আগে যে নবীই অতিক্রান্ত হয়েছেন তাকে তার জাতির কাছে পাঠানো হতো।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস বর্ণিত)। ‘প্রথমে নবীকে বিশেষভাবে তার জাতির কাছে পাঠান হত আর আমাকে সমগ্র মানবজাতির জাতির কাছে পাঠান হয়েছে।’ (বুখারী ও মুসলিম, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বর্ণিত)। ‘আমার আগমন ও কিয়ামতের অবস্থান এরূপ এ কথা বলতে গিয়ে নবী (সা.) নিজের দুটি আঙুল উঠান।’ (বুখারী ও মুসলিম)। এর অর্থ এই ছিল যে, ‘এ দু’টি আঙুলের মাঝখানে যেমন তৃতীয় কোনো আঙুলের অন্তরাল নেই, ঠিক তেমনি আমার ও কিয়ামতের মাঝখানে ও অন্য কোনো নবুয়্যতের অন্তরাল নেই। আমার পরে এখন আর শুধু রয়েছে কিয়ামত এবং কিয়াতম পর্যন্ত আমিই নবী ও রাসূল হিসেবে থাকব।’

৪. তোমাকে সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে পাঠিয়েছি
আর আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে পাঠিয়েছি, কিন্তু বেশিরভাগ লোক জানে না? (সূরা সাবা : ২৮)। আমি কোনো অভিনব রাসূল নই। এদের বলো, ‘আমি কোনো অভিনব রাসূল নই? কাল তোমাদের সাথে কী আচরণ করা হবে এবং আমার সাথেই বা কী আচরণ করা হবে তা আমি জানি না? আমি তো কেবল সেই অহির অনুসরণ করি, যা আমার কাছে পাঠানো হয় এবং আমি সুস্পষ্ট সাবধানকারী ছাড়া আর কিছুই নই?’ (সূরা আহকাফ : ৯)।

নবী (সা.) যখন নিজেকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে পেশ করলেন তখন মক্কার লোকেরা এ কথা শুনে নানা রকম কথা বলতে শুরু করলো। তারা বলতো, এ আবার কেমন রাসূল যার সন্তানাদি আছে, যে বাজারে যায়, পানাহার করে এবং আমাদের মতো মানুষের ন্যায় জীবনযাপন করে। তাহলে তার মধ্যে আলাদা কী বৈশিষ্ট্য আছে, যেদিক দিয়ে সে সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন এবং যার ফলে আমরাও বুঝতে পারবো যে, আল্লাহ বিশেষভাবে এই ব্যক্তিকেই তাঁর রাসূল বানিয়েছেন?
তারা আরো বলতো, আল্লাহ যদি এই ব্যক্তিকেই তাঁর রাসূল বানাতেন, তাহলে তার আরদালী হিসেবে কোনো ফেরেশতা পাঠাতেন। সেই ফেরেশতা ঘোষণা করতো, তিনি আল্লাহর রাসূল। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে সামান্যতম বেআদবিও করত সে তাকেই শাস্তিস্বরূপ বেত্রাঘাত করতো। আল্লাহ যাকে তার রাসূল হিসেবে নিয়োগ করবেন, তাঁকে মক্কার অলিতে-গলিতে এভাবে চলতে এবং সবরকম জুলুম-অত্যাচার বরদাশত করার জন্য অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবেন, তা কী করে হতে পারে? আর কিছু না হলেও অন্তত এতটুকু হতো যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলের জন্য একটি জাঁকালো রাজপ্রাসাদ এবং একটি সবুজ-শ্যামল তরতাজা বাগান তৈরি করে দিতেন। তাহলে তাঁর রাসূলের স্ত্রীর অর্থ-সম্পদ যখন নিঃশেষ হতো, তখন তাঁর অভুক্ত থাকার মতো পরিস্থিতি আসতো না এবং তায়েফ যাওয়ার জন্য সওয়ারী থাকতো।

গায়েবি বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইতো। তাদের ধারণায় কোনো ব্যক্তির আল্লাহর রাসূল হওয়ার অর্থ ছিল সে অতিমানবিক শক্তির মালিক হবে। তাঁর একটি ইঙ্গিত পাহাড় স্থানচ্যুত হবে, চোখের পলকে মরুভূমি শ্যামল-শস্য ক্ষেতে পরিণত হবে, অতীত ও ভবিষ্যৎ সবকিছু তাঁর জানা থাকবে এবং অদৃশ্য সবকিছু তাঁর কাছে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হবে। আয়াতটির ছোট ছোট অংশে এ কথাগুলোরই জবাব দেয়া হয়েছে।

একটি অংশে বলা হয়েছে, এদের বলো ‘আমি অন্য রাসূলদের থেকে ভিন্ন কোনো রাসূল নই।’ আমার পূর্বে বহু রাসূল এসেছিলেন। আমি তাদের থেকে আলাদা কিছু নই। পৃথিবীতে এমন কোনো রাসূল কখন এসেছেন যার সন্তানাদি ছিল না, কিংবা যিনি পানাহার করতেন না অথবা সাধারণ মানুষদের মতো জীবনযাপন করতেন না? কোন্ রাসূলের সাথে ফেরেশতা এসে তাঁর রিসালাতের ঘোষণা দিতো এবং তাঁর আগে আগে চাবুক হাতে চলতো? কোন্ রাসূলের জন্য বাগান ও রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দেয়া হয়েছে এবং আমি যে দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করছি আল্লাহর পথে ডাকতে গিয়ে কে তা করেনি? এমন রাসূল কে এসেছিলেন, যিনি তাঁর ইচ্ছামতো মু’জিজা দেখাতে পারতেন কিংবা নিজের জ্ঞান দিয়েই সবকিছু জানতেন?

তাহলে শুধু আমার রিসালাত পরখ করে দেখার জন্য এই অভিনব ও স্বতন্ত্র মানদ- তোমরা কোথা থেকে নিয়ে আসছো?
জবাবে তাদের এ কথাও বলো, ‘কাল তোমাদের সাথে কি আচরণ করা হবে এবং আমার সাথেই বা কী আচরণ করা হবে, তা আমি জানি না।’ আমি তো কেবল আমার কাছে প্রেরিত অহি অনুসরণ করি। অর্থাৎ আমি গায়েব নই যে, আমার কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবকিছু সুস্পষ্ট থাকবে এবং দুনিয়ার প্রতিটি জিনিসই আমার জানা থাকবে। তোমাদের ভবিষ্যৎ তো দূরের কথা আমার নিজের ভবিষ্যৎও আমার জানা নেই। আমাকে অহির মাধ্যমে যে জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হয়, আমি শুধু সেটাই জানি। এর চেয়ে বেশি জানার দাবি আমি কবে করেছিলাম এমন জ্ঞানের অধিকারী রাসূলই বা পৃথিবীতে কবে এসেছিলেন যে তোমরা আমার রিসালাত পরখ করার জন্য আমার গায়েবি জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে চাচ্ছো। হারানো বস্তুর সন্ধান বলা, গর্ভবর্তী নারী পুত্রসন্তান প্রসব করবে না কন্যাসন্তান এবং রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে না মারা যাবে এসব বলা কবে থেকে কাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব শেষে বলা হয়েছে, তাদের বলে দাও, আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই।

৫. পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাফের ও মুনাফিকদের মোকাবিলা করো
‘হে নবী! পূর্ণ শক্তি দিয়ে কাফের ও মুনাফিক উভয়ের মোকাবিল করো এবং তাদের প্রতি কঠোর হও? শেষ পর্যন্ত তাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট অবস্থান স্থল?’ (তাওবা : ৭৩)। তাবুক যুদ্ধের আগে পর্যন্ত মুনাফিকদের কার্যকলাপের ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। এর দু’টি কারণ ছিল। এক. তখনো পর্যন্ত মুসলমানদের হাত এত বেশি শক্তিশালী হতে পারেনি যে, বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে তারা ভেতরের শত্রুদের সাথেও লড়াই করতে পারতো। দুই. যারা সন্দেহ-সংশয়ে ডুবে ছিল ঈমান ও প্রত্যয় লাভ করার জন্য তাদের যথেষ্ট সুযোগ দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। এ দু’টি কারণ এখন আর বর্তমান ছিল না। মুসলিম শক্তি এখন সমগ্র আরব ভূখ-কে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে নিয়েছিল এবং আরবের বাইরের শক্তিগুলোর সাথে সংঘাতের সিলসিলা শুরু হতে যাচ্ছিল। এ কারণে ঘরের এ শত্রুদের মাথা গুঁড়া করে দেয়া এখন সম্ভবও ছিল এবং অপরিহার্যও হয়ে পড়েছিল। তাহলে তারা আর বিদেশি শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে দেশে আভ্যন্তরীণ বিপদ সৃষ্টি করতে পারতো না। তাছাড়া তাদের ৯ বছর সময় দেয়া হয়েছিল চিন্তাভাবনা করার, বুঝার এবং আল্লাহর সত্য দীনকে যাচাই-পর্যালোচনা করার জন্য। তাদের মধ্যে যথার্থ কল্যাণ লাভের কোনো আকাক্সক্ষা থাকলে তারা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারতো। এরপর তাদের আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়ার মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও এবার জিহাদ শুরু করে দিতে হবে এবং এদের ব্যাপারে এ পর্যন্ত যে উদার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে তার অবসান ঘটিয়ে কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে।

তাই বলে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ও কঠোর নীতি অবলম্বন করা মানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়। আসলে এর অর্থ হচ্ছে, তাদের মুনাফিকী মনোভাব ও কর্মনীতিকে এ পর্যন্ত যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং যে কারণে তারা মুসলমানদের সাথে মিলেমিশে থেকেছে, সাধারণ মুসলমানরা তাদের নিজেদের সমাজেরই একটি অংশ মনে করেছে এবং তারা ইসলামী দল ও সংগঠনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার ও ইসলামী সমাজে মুনাফিকীর বিষ ছড়াবার যে সুযোগ পেয়েছে, তা এখন ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। এখন যে ব্যক্তিই মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে মুনাফিকী নীতি অবলম্বন করবে এবং যার কার্যধারা থেকে এ কথাও প্রকাশ হবে, যে সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুনিমদের অন্তরঙ্গ বন্ধু নয়, সর্বসমক্ষে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে এবং নিন্দা করতে হবে। মুসলিম সমাজে তার মর্যাদা ও আস্থা লাভের সকল প্রকার সুযোগ খতম করে দিতে হবে। তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দলীয় পরামর্শের ক্ষেত্রে থেকে তাকে দূরে রাখতে হবে। আদালতে তার সাক্ষ্য অনির্ভরযোগ্য গণ্য করতে হবে। বড় বড় পদ ও মর্যাদার দরজা তার জন্য বন্ধ করে দিতে হবে। সভা-সমিতিতে তাকে গুরুত্ব দেবে না। প্রত্যেক মুসলমান তার সাথে এমন আচরণ করবে যাতে সে নিজে অনুভব করতে পারে যে, সমগ্র মুসলিম সমাজে কোথাও তার কোনো মর্যাদা ও গুরুত্ব নেই এবং কারো অন্তরে তার জন্য এতটুকু সম্ভ্রমবোধও নেই। তারপর তাদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে তার অপরাধ লুকানো যাবে না এবং তাকে ক্ষমা করাও যাবে না। বরং সর্বসমক্ষে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা চালাতে হবে এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।

এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ। এ পর্যায়ে মুসলমানদের এ নির্দেশটি দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ইসলামী সমাজকে অবনতি ও পতনের অভ্যন্তরীণ কার্যকারণ থেকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো না। যে জামায়াত ও সংগঠন তার নিজের মধ্যে মুনাফিক ও বিশ্বাসঘাতকদের লালন করে এবং যেখানে দুধকলা দিয়ে সাপ পোষা হয়, তার নৈতিক অধপতন এবং সবশেষে পূর্ণ ধ্বংস ছাড়া গত্যন্তর নেই। মুনাফিকী প্লেগের মতো একটি মহামারী। আর মুনাফিক হচ্ছে এমন একটি ইঁদুর যে এ মহামারীর জীবাণু বহন করে বেড়ায়। তাকে জনবসতির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়ার অর্থ গোটা জনবসতিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। মুসলমানদের সমাজে একজন মুনাফিকদের মর্যাদা ও সম্ভ্রম লাভ করার অর্থ হলো হাজার হাজার মানুষকে বিশ্বাসঘাতকতা ও মুনাফিকী করতে দুঃসাহস জোগানো। এতে সাধারণ্যে এ ধারণা বিস্তার লাভ করে যে, এ সমাজে মর্যাদা লাভ করার জন্য আন্তরিকতা, সদিচ্ছা ও সাচ্চা ঈমানদারীর কোনো প্রয়োজন নেই। বরং মিথ্যা ঈমানদের প্রদর্শনীর সাথে খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ অবলম্বন করেও এখানে মানুষ ফুলেফেঁপে বড় হয়ে উঠতে পারে। এ কথাটিই রাসূলুল্লাহ (সা.) তার একটি সংক্ষিপ্ত জ্ঞান-গর্ভ বক্তব্যের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বিদআতপন্থীকে সম্মান করলো সে আসলে ইসলামের ইমারত ভেঙে ফেলতে সাহায্য করলো।’ (প্রবন্ধটির সম্পাদনা তাফহীমুল কুরআন থেকে, কৃতজ্ঞতা ও দোয়া তাফহীমুল কুরআন ও তার লিখক আল্লামা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রহ.-এর জন্য)।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত আমীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও সাবেক সংসদ সদস্য।

কার্টেসীঃ সোনার বাংলা, সীরাত সংখ্যা-২০১৭