২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০০

দ্রব্যমূল্যে দুর্গতির বছর

চলতি বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়েছিল চাল, কাঁচামরিচ ও পিয়াজসহ সবজির দাম। চালের কেজি উঠেছিল ৭০ টাকার উপরে। ২০০ টাকায় বিক্রয় হয়েছে কাঁচামরিচের কেজি। আর সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে পিয়াজ। ৩০ টাকার পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকায়। ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে বছরজুড়েই দুর্গতি পোহাতে হয়েছে ক্রেতাদের।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক পদক্ষেপ না নেয়ায় চালের দাম এত বেড়েছে। এ ছাড়া বাজারে কোনো ধরনের মনিটরিং না থাকায় নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীন ছিল বলে অভিযোগ স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বছরের শুরুতে মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৮-৪০ টাকা। গত মে মাসে তা
৫০ টাকায় উঠে ছিল। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে নভেম্বরে তা কমে ৪০-৪২ টাকায় নেমে এসেছিল। কিন্তু সর্বশেষ গত দুই সপ্তাহে দাম কেজিতে আবার ২-৩ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ টাকায়। অথচ বাজারে আসছে নতুন চাল। গত ১১ মাসে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ। অন্যদিকে অনেক দেশে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে প্রতিদিনই বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড ছিল। এই একই চাল বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছিল ৩৮ টাকায়। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে ১১ মাসে মোটা চালের দর বেড়েছে ৩০.৪৩ শতাংশ।

খাদ্যনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল। যা দেশের সর্বোচ্চ চালের দাম। এর আগে ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা। এরপর ২০০৯ সালে চালের দাম কমে যায়। ২০১২ সালে প্রতিকেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দাম। ২০১৬ সালে মোটা চাল ৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দেশের চালের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়, মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৪৬-৪৮ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে মোটা চাল ৩৮-৪০ টাকা থাকলেও দাম বেড়ে যায় মিনিকেটের। এ সময় মিনিকেট বিক্রি হয় ৫০-৫২ টাকায়। মোটা চালের দাম মার্চ মাস থেকে বাড়তে শুরু করে। মার্চে মোটা চালের দাম হয় ৪০ টাকা। এ সময় মিনিকেটের দাম হয় ৫০-৫৩ টাকা। এপ্রিলে মোটা চালের দাম আরো ২-৩ টাকা বেড়ে হয় ৪২-৪৩ টাকা, মিনিকেটের দাম হয় ৫২-৫৫ টাকা। মে মাসে মোটা চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ টাকা, মিনিকেটের দাম ৫৬ টাকা। জুন মাসে মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৮ টাকায়, মিনিকেট ৫৬ টাকায়। তবে জুলাই মাসে চালের দাম কিছুটা কমে যায়। মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৬ টাকা ও মিনিকেট ৫৬ টাকায়। আগস্টেও দাম কমে ২ টাকা করে। এই সময় মোটা চাল ৪৪ টাকায় ও মিনিকেট বিক্রি হয় ৫৪ টাকায়; কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসে কেজিপ্রতি দাম বৃদ্ধি পায় ৮-১০ টাকা। বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায় আর মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকায়।

টিসিবি’র বাজারদরের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, এক মাসে সরু চালের দাম বেড়েছে ২-৩ টাকা। বর্তমানে সরু চালের কেজি ৫৮-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৫৬-৬৫ টাকা। উন্নতমানের নাজির ও মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৫ টাকা। বর্তমানে এই চালের কেজি ৬৪-৬৮ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৬০-৬৫ টাকা। আর মোটা চালের দাম বেড়েছে ৪ টাকা। বর্তমানে এই মানের চালের কেজি ৪৪-৪৬ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। আর বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, সাধারণ মানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ৩০.৩৪ শতাংশ। আর উন্নতমানের মিনিকেটের দাম বেড়েছে ২৬.৯২ শতাংশ। মোটা চাল স্বর্ণা/চায়না, ইরির দাম বেড়েছে ২৩.২৯ শতাংশ।

ক্যাব-এর সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ছয়-সাত লাখ টন চাল মজুত থাকলে এ সমস্যাটা হতো না।
বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল এনে বিক্রি করি। মাঝখানে সামান্য কিছু মুনাফা করি। মিল মালিকরা দাম বাড়ালে আমরা বৃদ্ধি করি।
এদিকে সামপ্রতিক সময়ে চালের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় বাংলাদেশে নতুন করে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়েছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সংস্থাটি বলেছে, এতে করে দারিদ্র্যের হার ০.৩২ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে চলতি বছর চালের সঙ্গে হু হু করে বেড়েছে পিয়াজের দাম। এক বছরে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৩৮.৪৬ শতাংশ। গত অক্টোবর থেকে দাম বাড়ার তালিকায় নাম লেখায় পিয়াজ। সেপ্টেম্বরে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া দেশি পিয়াজ দাম বাড়তে বাড়তে অক্টোবরে ৮০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় দেশি পিয়াজ। কিন্তু নভেম্বরের শেষদিকে তা ১০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলে। আর চলতি সপ্তাহে পিয়াজের দাম আরো বেড়ে ১৩০ টাকা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, দেশে বছরে প্রায় ২০-২২ লাখ টন পিয়াজের চাহিদা রয়েছে।
বছর শুরুতে আমদানি করা ও দেশি পিয়াজের কেজিপ্রতি দাম ছিল ২৫-৪০ টাকার মধ্যে। টিসিবি’র বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, এক বছর আগের এই সময় পিয়াজের কেজি ছিল ২৫-৪০ টাকা। বর্তমানে পিয়াজের কেজি ১২০-১৩০ টাকা। সে হিসাবে এক বছরে পিয়াজের দাম বৃদ্ধি হার ২৩৮.৪৬ শতাংশ।
আড়তদারদের মতে, আগস্টের শুরুতে টানা বৃষ্টির কারণে আড়তে পিয়াজ উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ফলে দাম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়নি।

রাজধানীর পিয়াজের পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের মেসার্স আজমিরী ভাণ্ডারের মালিক শাহীন বলেন, ভারতে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব দেশের বাজারে পড়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও দাম বেড়েছে।
এদিকে চাল-পিয়াজের মতো চলতি বছরের মাঝামাঝি বেড়েছিল কাঁচামরিচের দাম। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হয় ১৪০-১৬০ টাকা দরে। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ১৬০-২০০ টাকা দরে। আকাশচুম্বী দামে নাভিশ্বাস উঠে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষদের। টানা বর্ষণের ফলে কাঁচামরিচের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অজুহাত তুলেন ব্যবসায়ীরা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে পণ্যটির দামে। এদিন বাজারে বেগুন কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা; শিম ১২০ টাকা; হাইব্রিড টমেটো ১৬০ টাকা; দেশি টমেটো ১০০ টাকা; শশা ৫০ টাকা; চাল কুমড়া ৫০-৫৫ টাকা; কচুর লতি ৬০-৬৫ টাকা; পটল ৫০-৬০ টাকা; ঢেঁড়স ৫০-৬০ টাকা; ঝিঙ্গা ৬০ টাকা; চিচিঙ্গা ৫০-৬০ টাকা; করলা ৫০-৫৫ টাকা; কাকরোল ৫০ টাকা; পেঁপে ৪০-৫০ টাকা; কচুরমুখী ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি বাজারে পাওয়া যেত না।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=97746