২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৮

ইয়াবা সেবনে বাড়ছে নৃশংস অপরাধ

গলা কেটে হত্যা, ছিনতাই করতে গিয়ে শিশু খুন, স্ত্রীকে খুন করে পরে আত্মহত্যা—সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আলোচিত এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে ভয়ংকর মাদক ইয়াবার প্রভাব।
গত এক বছরের অপরাধ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মাদকের কারণে দুই শতাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আর এর অর্ধেকেরও বেশি খুনের কারণ ইয়াবাসংশ্লিষ্ট। ইয়াবাসেবী ও কারবারিরাই ব্যাপক মাত্রায় ছিনতাই, হত্যা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, চুরি ও ডাকাতিতে জড়িত।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত দেড় মাসে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া ১০টি হত্যাকাণ্ডসহ বড় ধরনের সব কটি অপরাধে জড়িতরা ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবাসেবীরা ক্রমেই ব্যাপকভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক অপরাধের ঘটনাটি ঘটে গত ১৮ ডিসেম্বর। রাজধানীর দয়াগঞ্জে এক নারীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। হ্যাঁচকা টানে ওই নারীর কোল থেকে পড়ে ছয় মাস বয়সের শিশু প্রাণ হারায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় অভিযুক্ত রাজীব আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) ইফতেখারুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, আসামি রাজীব ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য সে বেপরোয়া হয়ে ছিনতাই করেছিল। ইয়াবার প্রভাবে সে রাতে ঘুমাত না।
গত ১৫ ডিসেম্বর মহাখালীর আরজতপাড়ায় ৩৮/এ নম্বর বাড়িতে ৮০ বছরের অসুস্থ অনিল গোমেজের সামনে তাঁর স্ত্রী মিলড্রেড গোমেজ মিলুকে গলা কেটে খুন করা হয়। এ ঘটনায় ১৮ ডিসেম্বর পুলিশ জামির, পারভেজ ও নাঈম নামের তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, মহাখালী বস্তি এলাকার ওরা তিনজনই ইয়াবায় আসক্ত। মাদকের টাকার জন্যই ওরা অনিল গোমেজের বাসায় যায়। তারা রাতভর বাড়ির ছাদে বসে ইয়াবা সেবন করে। সকালে বাসায় ঢুকে মিলুকে হত্যার পর লুট করে পালিয়ে যায়।
গত ৮ অক্টোবর ওয়ারীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র খন্দকার আবু তালহা। এ ঘটনায় ১৮ অক্টোবর আব্দুর রহমান মিলন ও বেলাল হোসেন সবুজ নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওয়ারী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম মিয়া গতকাল বলেন, দুই আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। ওরা ইয়াবায় আসক্ত।

গত ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর শুক্রাবাদে নির্মাণাধীন ভবন থেকে নৌ প্রকৌশলী রফিকুল হাসান রিমনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই খুনের তদন্তেও ইয়াবা কারবারিদের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে। তাঁর ফ্ল্যাটে ইয়াবার আখড়া চালাত তারা। সন্দেহভাজন সাজেদুল করিম রনি ও তার স্ত্রী মমতাজ ময়নার সঙ্গে তাদের যোগ ছিল।
ইয়াবাসেবীরা ভয়ংকর : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রে ২০১৬ সালে যারা চিকিৎসা নিয়েছে, তাদের ৩১.৬১ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। কেন্দ্রের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন বলেন, ইয়াবায় আসক্তরা হেরোইনে আসক্তদের মতোই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। ২০-২৫ বছরের তরুণরাই এই নেশার জগতে দ্রুত ঢুকে পড়ছে। নেশাসক্ত এসব তরুণ-তরুণী পরিবারের জন্যও অশান্তির বড় কারণ হয়ে উঠেছে। অনেকে ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে।
ইয়াবায় আসক্ত কয়েকজনের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভয়ংকর বাস্তবতা। রাজধানীর নাখালপাড়া মসজিদ গলির এক বাসার ভাড়াটিয়া আজমল মিয়া কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। তিনি জানান, ইয়াবায় আসক্ত সন্তান নাজিমের অত্যাচারে পুরো পরিবার অতিষ্ঠ। প্রতিদিনই তাকে নেশার টাকা দিতে হয়। না দিলেই মারধর ও ভাঙচুর চালায় ঘরে। একদিন টাকা না পেয়ে ঘরের সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। এমনকি গত বছর জুন মাসে টাকা না পেয়ে নিজের ছোট বোনকে অপহরণ করে মা-বাবার কাছে ফোনে টাকা চায় সে। জানিয়ে দেয়, টাকা দিলেই মেয়েকে ফেরত দেওয়া হবে। ১৭ ঘণ্টা পর মাত্র এক হাজার টাকা দিয়ে ছেলের কাছ থেকে মেয়েকে মুক্ত করেন তিনি।

মুগদা এলাকার আরশাদ আলী বলেন, ‘আদরের সন্তান রশীদ কিভাবে যে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে বুঝতেই পারিনি। কলেজে যাওয়ার জন্য টাকা দিতাম। সেই টাকা দিয়ে সে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করত। ধীরে ধীরে সে পুরোমাত্রায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কলেজে যাওয়া ছেড়ে দেয়। ঘরের এটা-ওটা চুরি হতে থাকে। টাকা না পেলেই সে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এখন আর ঘরেই থাকে না। ৮-১০ দিন পর পর কোথা থেকে এসে হাজির হয় টাকার জন্য। মানসম্মানের ভয়ে টাকা দিয়ে বিদায় করে দিই। ’
ইয়াবা যেভাবে অপরাধী করে তোলে : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম রব্বানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব ধরনের মাদকাসক্তরা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা স্বভাবের হয়ে থাকে। সেই আলাদা স্বভাবের একটি হলো অপরাধপ্রবণতা। এ কারণে মাদককে বলা হয় অপরাধের মা (মাদার অব ক্রাইম)। তবে ইয়াবার উপাদান এমফিটামিন ভয়ংকর ক্ষতি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু থাকে না। হ্যালুসিনেশন হয়। ‘প্যারানয়েড ডিল্যুশন’ বা সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেয়। ইয়াবাকে বলা হয়, ‘মাইন্ড অলটারিং ড্রাগস’। এই মাদক সেবনে সাময়িক উদ্দীপনা বাড়ে, ঘুম কমে যায়, বিরক্তি বাড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার প্রবণতা বাড়ে। যার ফলে হত্যা-নির্যাতনের মতো নৃশংস কাজ করছে ইয়াবাসেবীরা।
ইয়াবার কারণে অনেক অপরাধ : তথ্যানুসন্ধানে ইয়াবায় আসক্তদের নির্মম অপরাধের অনেক ঘটনা পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট মালিবাগের চামেলীবাগে এক ফ্ল্যাটে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমান। ১৮ বছরের ওই তরুণী ইয়াবায় আসক্ত ছিল। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর ফকিরাপুলে পানির ট্যাংকির পাশ থেকে সুমি নামে এক তরুণীর আট টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তদন্তে জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল ইয়াবাসেবীরা।

গত ২১ জুন রূপনগর বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গলায় কাপড় পেঁচানো অবস্থায় হাইওয়ে পুলিশের এএসপি মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর শাহ আলম ওরফে বুড্ডা ২৩ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, মিন্টু, জাকির, ফারুক ও কামাল নামে চারজনের সঙ্গে ইয়াবা সেবন করে তারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। গত ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় গৃহবধূ সাজেদা আক্তার মীমকে হত্যা করে তার ইয়াবায় আসক্ত স্বামী শামিউল ইসলাম। ১৫ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী পশ্চিম মাতুয়াইলে মাদকাসক্ত বাবা সুমন তার শিশুসন্তান শাহীনকে (৭) দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ৬ অক্টোবর সোমা আক্তারকে গলা কেটে হত্যার পর তার স্বামী মনির আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পুলিশ ও স্বজনরা জানায়, মনির ইয়াবায় আসক্ত। ৩০ জুলাই রামপুরায় সাহানা নামের এক গৃহবধূকে হত্যা করে ইয়াবায় আসক্ত স্বামী। ২৯ জুলাই রাজধানীর শাহজাদপুরে আত্মহত্যা করেন মডেল-অভিনেত্রী রিসিলা বিনতে ওয়াজ। পরে পুলিশ ও স্বজনরা জানায়, রিসালা ভয়ংকরভাবে ইয়াবায় আসক্ত ছিল। ৮ অক্টোবর কদমতলীর মুজাহিদনগরে ইমরান হোসেন ও বনানীতে মোকারাম আদিল নামের দুই তরুণ আত্মহত্যা করে। পুলিশ জানিয়েছে, তারা ইয়াবায় আসক্ত ছিল। গত বছরের ২৯ অক্টোবর জুরাইনে বৃদ্ধ মোহর আলীকে গলা কেটে হত্যা করে তাঁর ইয়াবায় আসক্ত ছেলে সুমন।

এ ছাড়া ২ অক্টোবর গেণ্ডারিয়ায় যৌতুকের জন্য স্ত্রী-শাশুড়িকে এসিডে ঝলসে দেয় জিকু নামের এক ইয়াবাসেবী। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ৬ অক্টোবর ইয়াবা সেবন করিয়ে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামি তাপস শীলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৮ জুলাই পুরান ঢাকার ইসলামবাগে জাসদ নেতা মঞ্জুর হোসেনকে ইয়াবা ব্যবসার বিরোধে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২ আগস্ট রাতে চকবাজারের শ্মশানঘাট বাঁশপট্টিতে আল-আমিন নামের একজনকে গলা কেটে হত্যা করা হয় একই কারণে। ৭ জুলাই গেণ্ডারিয়ায় সাহেদ নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ইয়াবা কারবারিরা। এর আগে কামরাঙ্গীর চরে আলী হোসেনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ঠাণ্ডু নামের এক ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রেতা। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নিউ মার্কেটে হকার খোকন মোল্লাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ইয়াবা কারবারি সিন্ডিকেট। ৯ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইয়াবায় আসক্ত মোশাররফ স্ত্রী মিতু আক্তারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা করে। ২৩ তারিখে আড়াইহাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ী জাকির স্ত্রী সুমনাকে কুপিয়ে হত্যা করে।

নিয়ন্ত্রণই প্রতিকার : অপরাধ বিশেষজ্ঞ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, মাদকের সঙ্গে অপরাধের বড় সম্পর্ক রয়েছে। আর প্রচলিত মাদকই অপরাধের বড় কারণ। একেক সময় একেক ধরনের মাদক আসে। এখন ইয়াবার প্রাদুর্ভাব। ফলে ইয়াবার সরবরাহ কমানো বা ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি। এতে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ইয়াবাই এখন মাদক নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ। এই মাদকের কারণে সমাজে অপরাধ বাড়ছে। অনেক টাকার অপচয় হচ্ছে। আমরাও মনে করি ইয়াবাকেন্দ্রিক অপরাধ প্রতিরোধে বড় কাজ হলো সরবরাহ বন্ধ করা। এ কারণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা কিছু যন্ত্র কিনছি, যা দিয়ে ব্যাগে থাকা ইয়াবার মতো মাদক ধরা যাবে। ড্রপ টেস্ট বা মাদক গ্রহণের পরীক্ষার একটি প্রস্তাবও রয়েছে। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/12/26/581942