২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫৬

এবার কি দূর হবে বৈষম্য

কুষ্টিয়ার খোকসা-জানিপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক তোরান আলী মোল্লার বেতন স্কেল ১০ হাজার ২০০ টাকা। আর একই বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু হানিফের বেতন স্কেল তিন ধাপ ওপরে, ১২ হাজার ৫০০ টাকা। আগে এই পার্থক্য ছিল এক ধাপ। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালুর সময় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বেতনের এই পার্থক্য রচনা করেছে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের।
যদিও বরাবরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা সহকারী শিক্ষকদের থেকে বেতন স্কেলের এক ধাপ ওপরে অবস্থান করতেন। এ অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রধান শিক্ষকদের বেতন আরও এক ধাপ ওপরে নির্ধারণ করতে উদ্যোগ নেওয়ায় ফুঁসে ওঠেন সহকারী শিক্ষকরা। কারণ, প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের বেতনের পার্থক্য দাঁড়াবে চার ধাপ ওপর-নিচের।

এই অসন্তোষের ভিত্তিতে বেতন ও গ্রেড সংক্রান্ত বৈষম্য ঘুচিয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা। সারাদেশ থেকে এসে কয়েক হাজার শিক্ষক ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশনও শুরু করেন। তিন দিন পরে গতকাল সোমবার শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের আশ্বাসে তারা অনশন স্থগিত করেছেন। তারা এক মাসের মধ্যে সরকারের কাছে সুরাহা চেয়েছেন, অন্যথায় আবার রাজপথে আন্দোলন করার ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রী আশ্বাস দিলেও নিকট অতীতের নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার পটভূমিতে শিক্ষকদের মনে এখনই শঙ্কা তৈরি হয়েছে- এবার কি দূর হবে এই বৈষম্য?
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয় আশ্বাস দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আগেও আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এই বেতনবৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের। তারা বার বার বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কোনো ফল পাননি। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের বেতন স্কেলগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা বেতন পেতেন। কিন্তু ২০১৫ সালের অষ্টম বেতন কাঠামোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের ব্যবধান তিন ধাপ। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডে (মূল বেতন ১০ হাজার ২০০) বেতন পাচ্ছেন। আর প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন ১১তম গ্রেডে মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা। ইতিমধ্যে তাদের দশম গ্রেডে বেতন দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে যার মূল বেতন হবে ১৬ হাজার টাকা। সহকারী শিক্ষকরা এই বৈষম্য নিরসনে প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে ১১তম গ্রেডে (১২ হাজার ৫০০) তাদের বেতন চান।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আল-হেলাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক মুন্সি আশরাফুল আলম লিটন সমকালকে বলেন, 'তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলাই চন্দ্র মোদকের সঙ্গে তার বেতন স্কেলের বর্তমান পার্থক্য দুই হাজার টাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিলে তার সঙ্গে বেতন স্কেলের পার্থক্য গিয়ে দাঁড়াবে ১১ হাজার টাকায়। এতটা বৈষম্য মেনে সহকারী শিক্ষকরা কীভাবে শিক্ষকতা করবেন? পরিশ্রম তো সহকারী শিক্ষকরাই বেশি করেন। তবে কেন এই বৈষম্য?'
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি নাসরিন সুলতানা সমকালকে জানান, তারা এর আগে কয়েক দফায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া আর কোনো ফল মেলেনি।

ভোলার চর কুকরী-মুকরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইকবাল হোসেন, লালমোহনের একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহাবুদ্দিন, লালমোহন কালমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইকবাল হোসাইন, ডাওরীরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবুল্লাহ সমকালকে বলেন, গত তিন দশকে প্রধান ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে তিনবার বেতন পার্থক্য তৈরি করা হয়। যেখানে একই যোগ্যতা নিয়ে সবাই প্রাথমিক শিক্ষকতায় আসছেন, সেখানে কেন এই বৈষম্য?
চরফ্যাশন উপজেলার ৬১ নম্বর কুকরী-মুকরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইকবাল হোসেন জানান, এই বৈষম্য মানা যায় না। এ দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা।

লালমোহন উপজেলার ডাওরীরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবুল্লাহ বলেন, 'দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব আমরা। ২০ বছর চাকরি করার পর একজন সহকারী শিক্ষক যে বেতন পান, একজন প্রধান শিক্ষক চাকরির শুরুতেই সেই বেতন পান। এর ফলে পেনশন পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবো আমরা।'
জাতীয় প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ফাউন্ডেশনের সভাপতি শাহীনুর আকতার সমকালকে বলেন, 'প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতনবৈষম্য আছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পরের ধাপে নির্ধারণের দাবিতে আমাদের এই আন্দোলন। গত সাড়ে তিন বছর আন্দোলন করেও সমাধান না পাওয়ায় তারা অনশনে বসেছেন।'
বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি মো. আনিসুর রহমান সমকালকে বলেন, 'শিক্ষাগত যোগ্যতা এক হওয়ার পরও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতনে বৈষম্য রয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এটা ছিল না। এরপর থেকে ১৯৮৫ সালে এক ধাপ, ২০০৬ সালে দুই ধাপ এবং ২০১৪ সালে থেকে তিন ধাপের পার্থক্য তৈরি করা হয়েছে। এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন একাদশ গ্রেডে। আর আমাদের দেওয়া হচ্ছে চতুর্দশ গ্রেড। বর্তমান নিয়মে একজন প্রধান শিক্ষক বেতন স্কেলের দ্বাদশ গ্রেডে চাকরি শুরু করেন। আর সহকারী শিক্ষকরা সেই স্কেলে চাকরি শেষ করবেন। অর্থাৎ ১৬ বছর চাকরি করার পর সহকারী শিক্ষকরা পাবেন দ্বাদশ গ্রেড।'
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমাজের সভাপতি তপন মণ্ডল সমকালকে বলেন, 'তারা আশা করেছিলেন অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে তিন ধাপ বেতন পার্থক্যের সমাধান করা হবে; কিন্তু তা তিন ধাপই রয়ে গেল।'

http://samakal.com/bangladesh/article/17121517