২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪৩

কুলখানিতে নিহতের ঘটনা ও প্রাথমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রসঙ্গে

দেশটি এখন অঘটন ঘটন পটিয়সীতে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। কখন কোথায় কিভাবে কোন ঘটনা ঘটে যায় তা বুঝে ওঠা মুস্কিল হয়ে পড়েছে। আবার ঘটনার ঘনঘটা এত বেশি এবং পুনঃপৌনিকতার তীব্রতা এত দ্রুত যে, এর একটি আরেকটির দৃষ্টিসীমা দ্রুতই ছাড়িয়ে যায়। ফলে মানুষের অনুভূতির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা দিন দিন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী গত ১৫ ডিসেম্বর তারিখে মারা গেছেন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জনাব চৌধুরী আওয়ামী রাজনীতির ছকবাঁধা কাঠামোতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি নিজস্ব ভুবনের বাসিন্দা ছিলেন। তার মৃত্যুর চতুর্থ দিন আয়োজিত কুলখানি ও দোয়ার অনুষ্ঠানে আসা ১১ জন লোক খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতার পায়ের নিচে পড়ে মৃত্যবরণ করেছেন। এতে পদপিষ্ট হয়ে আরো প্রায় ৮০ জন অভ্যাগত ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। হতাহতের এই ঘটনা নজিরবিহীন। মহিউদ্দিন চৌধুরী একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। গত কয়েক দশকে তার প্রতিষ্ঠিত হজ্ব কাফেলায় শামিল হয়ে কয়েক হাজার লোক পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। এই কাফেলার সাথে তিনি নিজেও বহুবার হজ্ব করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার দোয়ার অনুষ্ঠানে ১১ জন লোকের মৃত্যু এবং প্রায় ৮০ জন লোকের আহত হবার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক।
চট্টগ্রামের বিখ্যাত আসকার দীঘিরপাড় এলাকায় রিমা কনভেনশন সেন্টারের এই দুর্ঘটনা সমগ্র জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী নিহত এবং আহত সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। চট্টগ্রামের সাগরিকা কম্যুনিটি সেন্টার ও রিমা কনভেনশন এই দুটি কেন্দ্র হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ছিল। জানা যায় যে, উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ১০টি কম্যুনিটি সেন্টারে লক্ষাধিক লোকের খবার আয়োজন করা হয়েছিল এবং এ জন্য ১০৭টি গরু ও প্রায় ৩০০ খাশি জবাই করা হয়েছিল।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা কম্যুনিটি সেন্টারে দোয়ার মাহফিলে অংশ নিতে নিশ্চয়ই আসেননি, এসেছিলেন ভোজে অংশ নিতে। তারা দলে দলে এসেছিলেন। বিশ্লেষকরা তাদের এত অধিক সংখ্যায় ভোজ সভায় যোগদানকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, অভাবের তাড়নায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষ এখন এত বেশি বিপর্যস্ত যে, এক বেলা পেটপুরে খাবার আশায় জীবনপণ রাখতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেননি। যারা মারা গেছেন, তারা অত্যন্ত দরিদ্র শ্রেণির লোক বলে জানা গেছে। ৪০/৫০ টাকা কেজি দামের চাল কিনে দুবেলা পেট পুরে ভাত খাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য পেট পুরে তারা খেতে পারেননি। গো মাংসের স্বাদ নেয়াও হয়নি। এই অবস্থার সাথে কয়েক মাস আগে ঢাকায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার তুলনা করা যায়। ঐ সময় তিন টাকা দরে ডিম বিক্রির ঘোষণা দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তারা প্রতিটি ডিম বাজারদর আট টাকার পরিবর্তে তিন টাকা দরে জনসাধারণকে ডিম দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণাপত্র জারি করেছিল। ফলে তিন টাকার ডিম কেনার জন্য নির্ধারিত স্থানে লক্ষ লক্ষ লোক জড়ো হয়। পরিণতিতে পুলিশের পেটা খেয়ে ডিম ছাড়াই তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। সেদিন ঢাকা শহরে বাঙালির বাঙালিপনার একটি নতুন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তাদেরই বা দোষ কি? শাসকদের শোষণ ও দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন তাদের জীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুলেছে। প্রতিবাদ বা প্রতিকারের পথ তারা খুঁজে পায় না। তাই কম দামে কেনা বা বিনা দামে একবেলা পেট পুড়ে খাবার আশা নিয়ে তারা জড়ো হয়। কেউ পুলিশের পেটা খায় আর কেউ পদদলিত হয়ে প্রাণ হারায়। এই তো জীবন। চট্টগ্রামে মৃতদের পরিবার প্রত্যেকে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবারের তরফ থেকে ১ লাখ টাকা, প্রশাসনের তরফ থেকে ১ লাখ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে ৫ লাখ টাকা অর্থাৎ মাথাপিছু ৭ লাখ টাকা পেয়েছেন। আহতরা কত পেয়েছেন জানা যায়নি। মৃত্যুর যে অপূরণীয় ক্ষতি তা কি এই টাকা দিয়ে পূরণ করা যাবে? বিস্মিত হলাম দোয়ার মাহফিলটি ১১ জন লোকের মৃত্যুর ফলে বদদোয়ার মাহফিলে পরিণত হওয়ায়।

১৯৭০ সাল। আজ থেকে ৪৭ বছর আগের ঘটনা। তখন তৎকালীন পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি অধুনালুপ্ত কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) অধ্যাপনা করতাম। ঐ বছর ডিগ্রি পরীক্ষায় পার্শ্ববর্তী জগন্নাথ কলেজে ইনভিজিলেশন ডিউটি পড়েছিল। একটি হলে আমাদের দু’জনের ডিউটি। আমি এবং ঐ কলেজেরই ইংরেজি বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক জনাব আবদুল মতিনের। পরীক্ষা শুরু হবার কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল একটি ছেলে বই খুলে নকল করা শুরু করেছে। প্রফেসর মতিন নিজে না গিয়ে আমাকেই বললেন, ইয়ং ম্যান তুমিই যাও। ছেলেটিকে চার্জ করলাম, কেন নকল করছো? খাতা কেড়ে নিলাম, ছেলেটির চেহারায় কোনও অপরাধবোধ দেখলাম না। সে জবাবে বললো, আমি তো নকল করছি না স্যার, বই দেখে আসলটি লিখছি। আমি লা-জওয়াব হয়ে পড়লাম, কথাটা তো সত্য, সে বই দেখে আসলটাই লিখছে। ছেলেটির মধ্যে অপরাধবোধ না দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। ঐ ছেলেটি তৎকালীন ছাত্রলীগের জগন্নাথ কলেজ শাখার সভাপতি ছিল বলে পরে জানতে পেরেছিলাম। কথাটা মনে পড়লো পরীক্ষার বর্তমান হালচাল দেখে। আগে পরীক্ষায় নকল করা হতো বই দেখে, বই এর কাটা পাতা, নোট বুক ও পাশের সিটের ছেলে বা মেয়েদের খাতা দেখে। কেউ আবার হাতের তালুতে নোট লিখে নকল করতো। এখন যুগ বদলানোর সাথে সাথে নকলের পদ্ধতিও বদলেছে এবং উন্নতি হয়ে এখন প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।

গত ১৮ ডিসেম্বর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী নাটোরে গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় জেলা প্রশাসন ১০২ টি স্কুলের ১ম ও চতুর্থ শ্রেণির পরীক্ষা বাতিল করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এর আগেও একাধিক জেলার প্রাথমিক স্কুলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ কি? যারা উচ্চ শ্রেণিতে পড়েন তাদের সবাইরই তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। জুনিয়র সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি, ডিগ্রি, মাস্টার্স এমনকি প্রফেশনাল পরীক্ষাগুলোসহ চাকরির পরীক্ষা, বিসিএস সব জায়গাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এ নিয়ে একটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে বলে মনে হয়। কেউ পড়তে চায় না, যারা চায় তারা সমাজে অপাংতেয়, ঁহভরঃ. পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এখন নকলবাজির আয়ত্তে চলে গেছে। সর্বত্র বাজিকরের খেলা। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসবাজি, দখলবাজি, প্রভৃতিরই এটি সম্প্রসারণ। আগে আমাদের শিক্ষার হার কম ছিল, মানুষের মনুষ্যত্বের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। এখন শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে নৈতিক মূল্যবোধ উড়ে যাচ্ছে, মনুষ্যত্ব লোপ পাচ্ছে; সর্বত্র অনাচার। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আমার কথা হচ্ছে ভেঙে পড়ার আর বাকি কোথায়? আমাদের জাতীয় জীবনের ১৭টি খাতের কোথাও এখন নীতি-নৈতিকতা বহাল নেই। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যবোধ সৃষ্টি, ভাল-মন্দ বাছাই করে গ্রহণ করার ক্ষমতা তৈরি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তা করতে পারছে না। মূল্যবোধ বিষয়টি ব্যাপক। মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে। জাতিগতভাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের ক্ষমতাসীনরা বুক ফুলিয়ে কখনো একথা বলতে পারে না যে, আমরা মুসলমান। দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামের নাম থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। ফলে ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনের কোনও পরিকল্পনাই আমরা নিই না। নেবই বা কেমন করে? যে দেশের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মে বিশ্বাস করেন না, নিত্য-মার্কসবাদের বড়ি খান এবং ধর্মকে আফিমের সমতুল্য বলে মনে করেন সে দেশে ধর্মীয় অনুশাসনের ছাঁচে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢালাই করা যায় না। সবকিছু ভেঙে পড়ার আগে এই সত্যই আমাদের উপলব্ধি করা দরকার। ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থা। শিক্ষা এই জীবন ব্যবস্থারই একটা অংশ এবং তওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতসহ এর প্রতিটি অংগকে সামনে রেখেই এর নৈতিক ভিত্তির সৃষ্টি। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা যদি এতে উজ্জীবিত হন তাহলে পরীক্ষায় নকল বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মোকাবিলা তারাই করবেন, পুলিশী ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে না। এতে সমাজের অবক্ষয়ও স্বাভাবিকভাবে রোধ হবে।

http://www.dailysangram.com/post/312615