২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:১৩

বেকার ৪ কোটি ৬৬ লাখ

বিনিয়োগ বিপর্যয়ের দায় দুর্নীতিবাজদের

দেশে বিনিয়োগে চরম হাহাকার চলছে। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কোনোভাবেই বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসছেন না বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান। বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুরবস্থার জন্য সরকারই দায়ী। মূলত এক শ্রেণীর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পড়ে সরকার বিনিয়োগবান্ধব কার্যকর পলিসি করতে পারছে না। অথচ দেশ ধ্বংসকারী চক্রটি সরকারের শীর্ষ মহলকে কাচের দেয়ালে ঘিরে রেখেছে। এরাই প্রতিনিয়ত সরকারকে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। দিনভর কাগুজে বিনিয়োগের সফলতা দেখিয়ে বাহাবা নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হতে হবে আড়াই লাখ কোটি টাকা, অথচ নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা। এতেই বেহাল চিত্রটা বোঝা যায়।

এই যখন অবস্থা, তখন নতুন করে শিল্প-কলকারখানা হওয়া তো দূরের কথা বিদ্যমান শিল্পপ্রতিষ্ঠানও হুমকির মুখে। ওদিকে কর্মসংস্থান না হওয়ায় বেকার যুবসমাজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এর জবাব তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেবেন। এ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এভাবে যারা সরকারকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে প্রকৃতপক্ষে এরা দুর্নীতিবাজ এবং সরকারের শত্রু। বিপদের সময় এদের কাউকে সরকারের পাশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবার আগে দেশ
ছেড়ে পালিয়ে যাবে। তাই সময় যদিও কম, তথাপি এ চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াসহ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মুখে না বলে দ্রুত ওয়ানস্টপ বিনিয়োগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে নয়। মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর ফলে আগামীতে সমস্যা আরও বাড়বে। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগের জন্য নিয়মিত কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ছাড়াও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং ঋণের উচ্চ সুদের হার উল্লেখযোগ্য।

জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ হারে প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির ২৪ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। অর্থাৎ আলোচ্য বছরে বেসরকারি খাতে ৫ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আসতে হবে। কিন্তু বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্র বলছে, অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বিডায় মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ নিবন্ধন এসেছে। যদিও এটা বাস্তব বিনিয়োগ নয়। এভাবে আগের বছরের এই সময়ে কাগুজে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। তুলনামূলকভাবেও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিনিয়োগ নিবন্ধন কমছে। এ ছাড়া ব্যাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, শিল্পঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না। বিনিয়োগের এ দুরবস্থার কথা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও একাধিকবার স্বীকার করছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে বর্তমানে দেশে ৪ কোটি ৬৬ লাখ লোক বেকার। আর ক্রমেই এ হার বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে আসছে। কিন্তু ওই অনুসারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এর বড় কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই।
অর্থনীতিবিদ এবং শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব কার্যকর পলিসি নেই। সমন্বিত কোনো নীতিমালাও নেই। আর সরকারের বিদ্যমান পলিসি শিল্প বিকাশের অন্তরায়। কেননা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো সার্ভিস পাওয়া যায় না। জমি কিনে একটি প্রজেক্ট পাস করাতে সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘাটে ঘাটে মাসের পর মাস ধরনা দিতে হয়। ঘুষ না দিলে দফায় দফায় নানা প্রশ্ন আর অজুহাত খাড়া করে হেনস্তা করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ টানতে গিয়ে উদ্যোক্তার নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনসহ অন্যান্য দেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে অতি দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু এক ছাতার নিচে সম্পন্ন করা সম্ভব।

তাদের মতে, দেশে বিনিয়োগের জন্য ৫টি মৌলিক সমস্যা রয়েছে। এগুলো হল- গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, জমির স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চসুদ, দুর্নীতি এবং উচ্চ করারোপসহ আমলতান্ত্রিক নানা জটিলতা। অর্থনীতিবিদরা বলেন, মুখে যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক না কেন, শিল্পায়নের বিকাশ না হলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ যে দেশে শিল্প বিপ্লব যত দ্রুত হয়, ওই দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি তত দ্রুত হয়। এটিই অর্থনীতির মৌলিক সূত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে ওই পরিবেশ নেই। বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হবে। এতে ব্যবসার ব্যয় কমবে। পণ্যের উৎপাদন খরচও কমবে।
বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। আর ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল তা এখনও বহাল আছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে এখনও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি তো আছেই। তার মতে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে অন্যতম সমস্যা হল ভূমি সংকট। তিনি বলেন, সংকট নিরসনে শক্তিশালী সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশকে উন্নত অবস্থানে দ্রুত নিয়ে যেতে চাইলে সাত দিনের মধ্যে প্রতিটি বিনিয়োগ প্রস্তাব এক টেবিলে অনুমোদন করা সম্ভব। প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়ার পর ৩ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতর স্পট ভিজিট সম্পন্ন করবে। বাকি ৪ দিনের মধ্যে এক টেবিলে বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কমন বৈঠক করে প্রস্তাব নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানি জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনা কঠিন কিছু হবে না।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকে দেশে গ্যাস সংযোগে দুর্নীতি হয়। টিআইবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টেও গ্যাসে দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। কাউকে সংযোগ দেয়া হয়, আবার কাউকে দেয়া হয় না। ফলে গ্যাস সংযোগ পেতে সরকারি দলের নেতা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। অন্যদিকে বড় শিল্পের জন্য বয়লার লাগে। কিন্তু গ্যাস ছাড়া বয়লার চলে না। আর কয়লা দিয়ে বয়লার চালাতে হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন না বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ফার্নেস অয়েল দিয়ে বয়লার চালানো সম্ভব নয়। কারণ এর দাম অত্যন্ত বেশি। ফলে ফার্নেস অয়েল দিয়ে বয়লার চালু করলে পণ্যের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। অর্থাৎ গ্যাস সংযোগ সমস্যার এখনও সমাধান হয়নি। অনেকে ভাগ্যগুণে শিল্পে গ্যাস সংযোগের অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত সরবরাহ লাইন করতে পারছেন না। অন্যদিকে চাহিদামাফিক শিল্প গড়ার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগে অনেক সমস্যা রয়েছে। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগে বড় ধরনের জটিলতা রয়েছে। এরপর লোডশেডিং তো বাংলাদেশের নিয়মিত সমস্যা।

এদিকে বিনিয়োগের জন্য অন্যতম সমস্যা হল পুঁজি। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে এর সুদের হার অত্যন্ত বেশি। ঋণের সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো ব্যাংক নামিয়ে আনলেও তা ৯ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। অথচ ভারত ও ভিয়েতনামে সুদের হার ৬-৭ শতাংশ। ক্ষেত্রবিশেষে আরও কম। এ ছাড়া বাংলাদেশে আমানত ও ঋণের সুদের ব্যবধান (স্প্রেড) অনেক বেশি। এ ব্যবধান কমিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কথা বলা হলেও তা কার্যকর করছে না ব্যাংকগুলো। অপরদিকে দেশে বিনিয়োগের অন্যতম একটি মৌলিক সমস্যা হল জমির অভাব। বর্তমানে এটি সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। শিল্পের জন্য জমি একেবারেই নেই। ফসলের জমি ব্যবহার করতে হলে ভূমি অফিসের (এসি ল্যান্ড) অনুমোদন লাগে। এ অনুমোদন নেয়া বিরাট জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপার।

সরকার বলছে, উন্নয়নের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ জরুরি। কিন্তু করণীয় কী তা বলছে না। বিনিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পলিসি গ্রহণ করা হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালুর কথা বলে আসছেন। কিন্তু সেই সেবা দেয়া হচ্ছে না। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডল যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের এ সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। তবে আমরা তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু একদিনে সবকিছু সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের জন্য আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। এ আইন সংসদে পাস হবে। এরপর কার্যকর করতে সময় লাগবে। তবে এতটুকু বলা যায়, সরকার বিনিয়োগ বাড়াতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/12/25/182075