২৫ ডিসেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৯:০৮

অবগুণ্ঠন উন্মোচন -আসিফ আরসালান

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য

অনেক দিন ধরে দেশে কোনো ধরনের ইলেকশন হয় না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে যে ইলেকশন হয় সেটি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোট এবং অন্যান্য আরো ১২ টি দল বয়কট করে। ফলে যে নির্বাচনটি গায়ের জোরে করা হয় সেটি বস্তুত একটি তামাশার নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এই দুই সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশন হয়। সেই দুটি ইলেকশনও প্রহসনের নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায়। নির্বাচনের ১ মাস আগে একজন সম্ভাব্য ও শক্তিশালী প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে ২২ মাস ধরে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। আরেকজন শক্তিশালী প্রার্থীকে অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তখন তার পুত্রকে প্রার্থী করা হয়। সেই নির্বাচনেও গণহারে ভোট চুরি, বিরোধীদলীয় প্রার্থীর এজেন্টগণকে বের করে দেওয়া হয় এবং ব্যালট পেপারে সিল মারার মহোৎসব চলে। এর আগে গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল প্রভৃতি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বত্রই বিএনপি প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। বিএনপির পক্ষে বিপুল জনজোয়ার দেখে সরকার সতর্ক হয়ে যায়। নির্বাচনের পর বিএনপিপন্থী সমস্ত মেয়রকে কোন না কোন ছুতা নাতায় বরখাস্ত করা হয় এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। মেয়রগণ আদালতের দারস্থ হন এবং মেয়র পদে পুনর্বহাল হন। সরকার আদালতের রায়ের প্রতি কর্ণপাত না করে আবার নতুন বাহানা খুঁজে তাদেরকে বরখাস্ত করে এবং গ্রেফতার করে। এভাবে পরবর্তী ৫টি বছর মেয়রগণের কোর্ট-কাচারী ও জেলখানায় আসা যাওয়ার মধ্যদিয়ে কেটে যায়। সুতরাং বিএনপি এবং বিরোধী দল ধরেই নিয়েছে যে তাদেরকে এই সরকার কোন ইলেকশনে জিততে দিবে না।

এই পটভূমিতে গত ২১ তারিখ বৃহস্পতিবার রংপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশন। রংপুর সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটি ছিল দ্বিতীয় ইলেকশন। সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। ইলেকশন হওয়ার পর ২ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। পত্র পত্রিকায় এ সম্পর্কে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে এবং অধিকাংশ পত্রিকাতেই নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে বিভিন্ন রকম ভাষ্য এবং বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। আপনারা মোটামুটি কমবেশি সেসব বিশ্লেষণ এবং ভাষ্য পড়েছেন। আমি আর সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে কয়েকটি ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট উল্লেখ না করলেই নয়।
এখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও প্রার্থীগণ নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করছেন। ২০১২ সালের প্রথম নির্বাচনে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করেননি অথবা দলীয় প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, ২০১৩ সালে প্রধান যে তিনজন প্রার্থী ছিলেন এবারেও কিন্তু তারাই প্রার্থী ছিলেন। অবস্থার পরিবর্তন শুধু এটুকুই হয়েছে যে ২০১২ সালে তারা দলীয় মার্কা ব্যবহার করেননি, কিন্তু এবার তারা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করেছেন।

যেমন ২০১২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। সেবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই মেয়র পদে জয়লাভ করেছিলেন। এবারও তিনি ক্যান্ডিডেট ছিলেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন। অপর একজন প্রার্থী ছিলেন কাওসার জামান বাবলা। তিনি গতবার নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে ইলেকশন করেছেন। এবার তিনি ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির তরফ থেকে ইলেকশন করেছেন। এবার তিনি পরাজিত হয়েছেন এবং তৃতীয় অবস্থানে অবস্থান করছেন। অপর একজন প্রার্থী হলেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। গতবারেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং পরাস্ত হয়েছেন। এবার তিনি লাঙ্গল মার্কা নিয়ে ইলেকশন করেছেন এবং জাতীয় পার্টির তরফ থেকে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। অতীতে সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদের মত ইলেকশনগুলোকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বলা হত। তখন আরো বলা হতো যে এখানে কোন পলিটিক্যাল ফ্যাক্টর কাজ করে না। প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং সুনামের ওপর নির্বাচনী ফলাফল নির্ভর করতো। কিন্তু গতবার থেকে ইলেকশনের চরিত্র বদলে গেছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও রাজনৈতিক রং ধারণ করেছে।

॥দুই॥
আগামীতে আরো ৫ টি সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশন হবে। রংপুরসহ সংখ্যা হবে ৬। এই ৬ টি সিটি কর্পোরেশনের ইলেকশনের মধ্যে সর্বপ্রথম ইলেকশন হওয়াতে সারা দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল রংপুর ইলেকশনের ওপর। রংপুর ইলেকশন নিয়ে সকলের আগ্রহের আরেকটি কারণ হলো এই যে এটি যেহেতু রংপুর সদরের ইলেকশন, তাই এখানে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ একটু বেশি ছিল। কারণ প্রথমত রংপুরকে সিটি কর্পোরেশন বানিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১২ সালের প্রথম নির্বাচনে এই ঝন্টুই মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার তিনি আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ক্যান্ডিডেট। তাই কেউ কেউ মনে করতেন যে তিনি জিতবেন। অবশ্য রংপুর শহরে যারা সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেছেন তারা কিন্তু বলেছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেছেন যে শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু মেয়র হওয়ার পর ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। মেয়র হওয়ার পর তিনি জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও সরকারে আছে আওয়ামী লীগ এবং সংগঠন হিসেবে রংপুর সদরে আওয়ামী লীগের ভিত্তি স্ট্রং।

অন্যদিকে বিগত ২৪ বছর ধরে অর্থাৎ ৫টি মেয়াদব্যাপী সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ রংপুর সদরের এমপি। এমনকি ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে তার পতন ঘটলেও পরবর্তীতে দেশব্যাপী যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেই নির্বাচনেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে জয়লাভ করেন এবং তার দল সেই নির্বাচনে ৩৫টি আসন লাভ করে। এখনও তিনি সেই আসন থেকেই এমপি রয়েছেন (অবশ্য ২০১৪ সালের যে নির্বাচনে তিনি এমপি হয়েছেন সেটিকে সকলেই ভোটার বিহীন নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন)। সুতরাং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অন্তত রংপুর সদরে এরশাদের ব্যক্তিগত প্রভাবের একটি ছায়াপাত ঘটবে বলে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল ধারণা করছিলেন। সাথে সাথে এ কথাও ঠিক যে জনাব এরশাদ একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধান মন্ত্রীর ব্যক্তিগত দূতের পদে অধিষ্ঠিত আছেন। রংপুর ইলেকশনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি রংপুর শহরের নিজ বাসভূমে অবস্থান করেছেন। তবে জাতীয় পার্টির লোকজন বলছেন যে প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্রকাশ্যে ইলেকশন ক্যাম্পেইন করেননি। সে যাই হোক, মন্ত্রীর মর্যাদায় রংপুরে তার অবস্থান যে পরোক্ষভাবে হলেও নির্বাচনের ওপর একটি প্রভাব ফেলবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

॥তিন॥
সব কেন্দ্রের ফলাফল পাওয়া গেছে এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফাকে বেসরকারিভাবে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফল ইতোমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। তাই সেটি নিয়ে আর বিশদ আলোচনায় গেলাম না। যে বিষয়টি সর্ব মহলে আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো, আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঝন্টু শুধুমাত্র যে পরাস্ত হয়েছেন তাই নয়, গতবারে তিনি যে ভোট পেয়েছিলেন এবার তার চেয়ে ৪৩৮৫৫ ভোট কম পেয়েছেন। আরো দেখা যাচ্ছে যে বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা পরাস্ত হলেও গতবারে যে ভোট পেয়েছিলেন এবার তার চেয়ে ১৩ হাজার ৯ শত ১ ভোট বেশি পেয়েছেন। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় এবার ঝন্টুর ভোট কমেছে ৫৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে বিএনপি প্রার্থী হেরে গেলেও তার ভোট বেড়েছে ৬০ শতাংশ। সে জন্যই সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন যে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মোটামুটি বিএনপি এবং আওয়ামী প্রার্থীর মধ্যে। বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে আওয়ামী প্রর্থীর ভোট বেশি হলেও দেখা যাচ্ছে যে আওয়ামী লীগের ভোট বিপুল অংশে কমেছে।

আরো একটি বিষয় এখানে লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। তাদের প্রার্থী এটিএম গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন ২৪ হাজার ৬ শত ভোট। জামায়াতে ইসলামীর ভোটারও কম নয়। জামায়াতের যে হাজার হাজার ভোট রয়েছে সেটি কোন দিকে গেছে, সেই বিষয়টি গতকাল শনিবারের কোন পত্রিকাতেই বলা হয়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছেন যে ভোটের আগে বিএনপি ভাল করে হোম ওয়ার্ক করেনি। ধারণা করা হয় যে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিএনপিকে সহযোগিতা করছে। কিন্তু রংপুরের নির্বাচনী প্রচারণনার সময় এবং নির্বাচনী ফলাফল দৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে যে ইসলামী দলগুলোর সাথে বিএনপির রাজনৈতিক সমঝোতা এবং সমন্বয় ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের ভোট বিএনপির বাক্সে পড়তো এবং জামায়াতসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী দলের ভোট ধানের শীষে পড়তো তাহলে সাধারণ হিসেব অনুযায়ী বিএনপি জয়লাভ করতেও পারতো। আর যদি জয়ী নাও হতে পারতো তাহলে খুব কম মার্জিনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকতো। যে ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা বিএনপি অতীতে বলতো, এবার রংপুরের নির্বাচনে সেই মূল্যবোধ ও চেতনার ধারক যে বিএনপি সেটি জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়নি।

এই নির্বাচন শুধুমাত্র বিএনপি নয়, ইসলামী মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সমস্ত দল, নেতা ও কর্মীদের জন্য এই শিক্ষাই বয়ে এনেছে যে এখন শুধু স্থানীয় সরকারে নয়, সমগ্র দেশের জন্য যেটি প্রয়োজন সেটি হলো, জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির শিলা অটল ঐক্য। এই মুহূর্তে যেটি প্রয়োজন সেটি হলো সেক্যুলার ও বাম রাজনৈতিক ঘরানাকে রাজনৈতিকভাবে তথা আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করা। এর সাথে জড়িত আমাদের ইমান, আকিদা, সার্বভৌমত্ব এবং সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করা।

 

http://www.dailysangram.com/post/312392